Ticker

10/recent/ticker-posts/

ক্ষমা প্রদর্শন ও অজ্ঞ-মূর্খদের সযত্নে এড়িয়ে চলা।

ক্ষমা প্রদর্শন ও অজ্ঞ-মূর্খদের সযত্নে এড়িয়ে চলা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন।

সূরা আল-আ'রাফ-এর ১৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন:
“ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোলো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খ জাহেলদের থেকে দূরে থাকো।”

এই দর্শনের দুইটি প্রধান অংশ এবং এর প্রভাব নিচে আলোচনা করা হলো:

১. ক্ষমা প্রদর্শন (Forgiveness)

ক্ষমা দুর্বলতা নয়, বরং শক্তির প্রতীক। প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যিনি ক্ষমা করেন, তিনিই প্রকৃত বীর।

মানসিক প্রশান্তি: ক্ষমা করলে মনের ভেতর থেকে ঘৃণা ও ক্ষোভের আগুন নিভে যায়। এটি মানুষকে মানসিক চাপমুক্ত রাখে।

সম্পর্ক রক্ষা: ছোটখাটো ভুলত্রুটি ক্ষমা করার মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় থাকে।

আল্লাহর সন্তুষ্টি: আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং তিনি ক্ষমাকারীকে পছন্দ করেন। হাদিসে বলা হয়েছে, কেউ যদি অন্যের দোষ গোপন রাখে বা ক্ষমা করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে ক্ষমা করবেন।

২. অজ্ঞ-মূর্খদের সযত্নে এড়িয়ে চলা (Avoiding the Ignorant)

এখানে 'অজ্ঞ' বা 'মূর্খ' বলতে কেবল নিরক্ষর মানুষকে বোঝানো হয়নি; বরং যারা যুক্তি মানে না, অহেতুক তর্কে লিপ্ত হয় এবং আচরণের শিষ্টাচার জানে না—তাদের বোঝানো হয়েছে।

তর্ক না করা: মূর্খদের সাথে তর্কে জেতা যায় না। তারা যুক্তি বোঝে না, বরং তাদের সাথে কথা বললে নিজের সম্মানহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সময়ের অপচয় রোধ: অজ্ঞদের সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়া মানে নিজের মূল্যবান সময় ও মেধার অপচয় করা।

নিরাপত্তা ও সম্মান: এদের এড়িয়ে চলার মাধ্যমে আপনি অপ্রয়োজনীয় বিবাদ ও শত্রুতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।

কুরআনের সূরা আল-ফুরকান (আয়াত ৬৩)-এ আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:
“আর রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞরা যখন তাদের সাথে সম্বোধন (তর্ক) করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (শান্তি)।”

ক্ষমা প্রদর্শন ও অজ্ঞ-মূর্খদের এড়িয়ে চলা—এই দুটি বিষয় সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে (হাদিসে) অত্যন্ত শক্তিশালী নির্দেশনা রয়েছে। নিচে নির্দিষ্ট আয়াত নম্বর ও হাদিস গ্রন্থসহ রেফারেন্সগুলো তুলে ধরা হলো:

পবিত্র কুরআন বলাহয়েছে।

১. তিনটি মূল নীতি (ক্ষমা, সৎকাজ, বর্জন):
সবচেয়ে সরাসরি আয়াতটি হলো সূরা আল-আ'রাফ-এর ১৯৯ নম্বর আয়াত, যেখানে আল্লাহ নবীজি (সাঃ)-কে তিনটি নির্দেশ দিয়েছেন।

“আপনি ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং মূর্খ জাহেলদের থেকে দূরে থাকুন।”
(সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৯৯)

২. আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য:
আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা (ইবাদুর রহমান)-এর গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

“আর রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা যখন তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ (শান্তি)।”
(সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৩)

৩. অসার বা বাজে কথা এড়িয়ে চলা:
যারা জ্ঞানহীন বা মূর্খ, তারা প্রায়ই অসার কথাবার্তা বলে। তাদের এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন:

“তারা (মুমিনরা) যখন অসার বা বাজে কথাবার্তা শোনে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, ‘আমাদের কাজের ফল আমরা পাব, আর তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তি), আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়াতে চাই না’।”
(সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৫)

৪. মন্দের জওয়াব ভালো দিয়ে দেওয়া:

“ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। আপনি মন্দকে প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট (ভালো ব্যবহার/ক্ষমা)। ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে, সেও অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে।”
(সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৪)

পবিত্র হাদিসে বলাহয়েছে।

১. ক্ষমার মর্যাদা:
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

“সদকা করলে সম্পদ কমে না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তাকে উচ্চাসনে আসীন করেন।”
(সহিহ মুসলিম: ২৫৮৮)

২. মূর্খদের সাথে আচরণের পদ্ধতি:
মূর্খদের আচরণে ধৈর্য ধারণ করা সম্পর্কে একটি বিখ্যাত ঘটনা রয়েছে। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন:

“একবার আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে হাঁটছিলাম। তাঁর গায়ে নাজরানের তৈরি মোটা পাড়ের একটি চাদর ছিল। এক বেদঈন (অজ্ঞ গ্রাম্য লোক) এসে তাঁর চাদর ধরে এত জোরে টান দিল যে, আমি দেখলাম নবীজির কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে গেছে। এরপর সে বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আল্লাহর যে সম্পদ তোমার কাছে আছে, তা থেকে আমাকে কিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করো।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার দিকে তাকালেন এবং (রাগ না করে) মুচকি হাসলেন। এরপর তাকে কিছু দান করার নির্দেশ দিলেন।”
(সহিহ বুখারী: ৩১৪৯, সহিহ মুসলিম: ১০৫৭)
(এটি অজ্ঞদের আচরণের প্রতি ক্ষমা ও সহনশীলতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত)

৩. আত্মীয় বা পরিচিতদের সাথে ক্ষমা:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ)-কে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন:

“হে উকবা! আমি কি তোমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বোত্তম চরিত্রের কথা জানাব না? তা হলো— যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তুমি তার সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগাবে; যে তোমাকে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে দান করবে; আর যে তোমার ওপর জুলুম করে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দেবে।”
(মুসনাদে আহমাদ: ১৭৩৩৪, শুআবুল ঈমান: ৮১২৫)

৪. মূর্খদের তর্কে নীরব থাকা:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:

“আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের একপাশে একটি ঘরের জিম্মাদার হচ্ছি, যে ব্যক্তি সত্যের ওপর থেকেও তর্ক পরিহার করে।”
(সুনানে আবু দাউদ: ৪৮০০)
(মূর্খদের সাথে তর্কে জড়ালে সত্য প্রতিষ্ঠা হয় না, বরং বিবাদ বাড়ে। তাই সত্য জেনেও তাদের এড়িয়ে চলা উত্তম)

সারসংক্ষেপ:
কুরআন ও হাদিসের আলোকে—ক্ষমা করা দুর্বলতা নয়, বরং উচ্চতর চারিত্রিক গুণ। আর অজ্ঞ বা মূর্খদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে তাদের ভদ্রভাবে এড়িয়ে যাওয়া বা ‘সালাম’ দিয়ে বিদায় নেওয়া মুমিনের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
জীবনে সুখী ও সফল হতে হলে এই নীতিটি মেনে চলা জরুরি। নিজের মানসিক শান্তির জন্য ক্ষমা করে দিন এবং নিজের আত্মসম্মান ও সময় বাঁচাতে অজ্ঞদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে নীরবতা পালন করুন বা ভদ্রভাবে এড়িয়ে যান।

#মুহাম্মদের_বাণী #ইসলামিক_একাডেমি_এনপি #হে_মুমিনগণ! #ইবনে_মাজাহ  #হাদীস_বিশ্ব_নবীর_বাণী  #সুনানে_ইবনে_মাজাহ #রিয়াদুস_সালেহীন

Post a Comment

0 Comments