আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা পাওয়া একজন মুমিনের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য। যখন আল্লাহ কাউকে ভালোবাসেন, তখন সেই বান্দার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই সফল হয়ে যায়। আপনার অনুরোধ অনুযায়ী এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা নিচে তুলে ধরা হলো:
১. বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার আলামত (লক্ষণসমূহ)
কুরআন ও হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তার মধ্যে কিছু বিশেষ লক্ষণ প্রকাশ পায়:
সৎকাজের তাওফিক ও ইবাদতে প্রশান্তি: আল্লাহ যখন কাউকে ভালোবাসেন, তখন তাকে নেক কাজ করার সুযোগ করে দেন এবং পাপ কাজ থেকে দূরে রাখেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ যখন কোনো বান্দার কল্যাণ চান, তখন তাকে (ভালো কাজে) ব্যবহার করেন।” (তিরমিজি)
দুনিয়াতে গ্রহণযোগ্যতা: বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে, আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি জিবরাঈল (আঃ)-কে ডেকে বলেন, "আমি অমুককে ভালোবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাসো।" এরপর জিবরাঈল (আঃ) আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা দেন। ফলে পৃথিবীতেও সেই ব্যক্তির জন্য মানুষের মনে ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দেওয়া হয়।
ঈমানের ওপর পরীক্ষা: আল্লাহ যাঁদের ভালোবাসেন, তাঁদের বিভিন্ন বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। হাদিসে আছে, “বিপদ যত কঠিন হয়, পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, তখন তাদের পরীক্ষায় ফেলেন।” (তিরমিজি)
দুনিয়া বিমুখতা: আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে দুনিয়ার মোহ থেকে রক্ষা করেন। যেমন ডাক্তার রোগীকে ক্ষতিকর খাবার থেকে বিরত রাখেন, তেমনি আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাকে দুনিয়ার চাকচিক্য ও পাপাচার থেকে দূরে রাখেন।
তওবা ও কোমল হৃদয়: প্রিয় বান্দার অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিগলিত থাকে এবং কোনো ভুল হলে সাথে সাথে সে তওবা করে। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন” (সূরা বাকারা: ২২২)।
২. এই ভালোবাসা অর্জনের উৎসাহ
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের চেয়ে বড় কোনো সম্পদ নেই। এর প্রতি উৎসাহী হওয়ার কিছু কারণ:
আল্লাহর জিম্মাদারি: যাকে আল্লাহ ভালোবাসেন, তিনি তার কান হয়ে যান যা দিয়ে সে শোনে, চোখ হয়ে যান যা দিয়ে সে দেখে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাকে সবসময় সঠিক পথে পরিচালিত করেন (হাদিসে কুদসি)।
জান্নাতের নিশ্চয়তা: আল্লাহর ভালোবাসা পেলে জাহান্নামের আগুন সেই বান্দার জন্য হারাম হয়ে যায় এবং জান্নাত অবধারিত হয়।
মানসিক প্রশান্তি: আল্লাহর ভালোবাসা বান্দার মনে এমন এক প্রশান্তি (সাকিনা) তৈরি করে, যা পৃথিবীর কোনো সম্পদ দিতে পারে না।
৩. আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের উপায় ও চেষ্টা
আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বান্দাকে সচেতনভাবে কিছু কাজ করতে হয়:
ক. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাতের অনুসরণ (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ):
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে শর্ত দিয়েছেন:
“বলুন (হে নবী), যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার (নবীর) অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।” (সূরা আলে-ইমরান: ৩১)
সুতরাং, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীর সুন্নাত মেনে চলাই আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার প্রধান উপায়।
খ. নফল ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া:
ফরজ ইবাদত আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ভিত্তি, কিন্তু নফল ইবাদত আল্লাহর বিশেষ ভালোবাসা এনে দেয়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন:
“বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার এতই নিকটবর্তী হয় যে, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি।” (বুখারি)
যেমন: তাহাজ্জুদ, ইশরাক, নফল রোজা এবং বেশি বেশি জিকির।
গ. আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও ঘৃণা:
কারও সাথে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা—সবই হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। হাদিসে আছে, যারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, কিয়ামতের দিন তারা নূরের মিম্বারে থাকবে।
ঘ. উত্তম চরিত্র (আখলাক):
মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার, নম্রতা এবং দয়া প্রদর্শন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয়, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর।”
ঙ. কুরআন তিলাওয়াত ও অনুধাবন:
আল্লাহর কালামের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। যারা কুরআনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।
চ. সবর (ধৈর্য) ও তাওয়াক্কুল (ভরসা):
বিপদে ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন” এবং “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর ওপর ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।”
#রিয়াদুস_সালেহীন ১ম খণ্ড অনুচ্ছেদঃ ৪৭,
পরিশেষে:
আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারি যা রাসূল (সাঃ) শিখিয়েছেন:
“আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুব্বাকা, ওয়া হুব্বা মান ইউহিব্বুকা, ওয়াল আমাল আল্লাজি ইউবাল্লিগুনি হুব্বাকা।”
(অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার ভালোবাসা চাই, এবং ওই ব্যক্তির ভালোবাসা চাই যে আপনাকে ভালোবাসে, এবং এমন আমল করার তৌফিক চাই যা আমাকে আপনার ভালোবাসার কাছে পৌঁছে দেবে।)

0 Comments