Ticker

10/recent/ticker-posts/

নবী (সাঃ) প্ৰেমে খোদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত

নবী (সাঃ) প্ৰেমে খোদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত


আল্লাহর হাবিব (দ.)-এর প্রতি ভালবাসা প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনের একমাত্র মাধ্যম। যুগে যুগে যারা আল্লাহর অলি বা বন্ধু হয়েছেন সকলেই প্রিয় নবীর প্রতি অগাধ ভালবাসা, ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে হয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন পবিত্র কোরআনে- 

قُلۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُحِبُّوۡنَ اللّٰہَ فَاتَّبِعُوۡنِیۡ یُحۡبِبۡکُمُ اللّٰہُ وَیَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَاللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

(সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-৩১) 


অর্থ- হে হাবীব (দ.), আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল,দয়াবান।


হযরত হাসান (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা কিছু গোত্রের লোকেরা আল্লাহর রসুল (দ.)-কে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ (দ.) আমরা আল্লাহকে ভালবাসি। তখন উপরোক্ত আয়াতে করিমা আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেন। অপর বর্ণনায় রয়েছে যে, উপরোক্ত আয়াতে করিমা কাব বিন আশরাফ প্রমুখদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তারা বলে-

نحن أبناء الله وأحباؤه ونحن أشد حبا لله فأنزل الله الآية


অর্থ্যাৎ: আমরা আল্লাহর সন্তান এবং তাঁর প্রিয়। আমরা আল্লাহকে সর্বোচ্চ ভালবাসি । তখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন। 

[শিফা শরীফ কৃত আল্লামা কাজী আয়াজ (রহ.), পৃ-২৬৫]


আমরা বুঝতে পারলাম কেউ মুখে হাজারো বার আল্লাহর ভালবাসা দাবী করলেও প্রকৃত পক্ষে সে দাবী সঠিক নয়। কারণ আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে প্রথমে নবীর অনুসরণ তথা গোলামী কবুল করতে হবে। নবীর গোলামরাই প্রকৃত খোদা প্রেমিক হবে।


উপরোক্ত আয়াত হতে আমরা আরো উপলব্ধি করতে পারি আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রিয় নবী (দ.)-এর অনুসরণ। আরো সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নবীর অনুসরণ করলে বান্দা আল্লাহর পক্ষ হতে দুটি পুরষ্কার প্রাপ্ত হন- ১) মহান আল্লাহর ভালোবাসা, ২) কৃত পাপরাশির ক্ষমা । 


অতএব প্রমানিত হল যে, নবীর অনুসরণ করলেই বান্দা আল্লাহর ভালবাসা লাভ করে এবং কৃত গুনাহের মাফ পেয়ে নির্দোষ হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় রুপান্তরিত হয়।


এবার আসুন, নবীর অনুসরণ কারা করে? যার নিকট নবীর ভালবাসা আছে সেইতো নবীর অনুসরণ করে। প্রিয় নবীর অনুসরণ ও ভালবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হযরাতে সাহাবায়ে কেরাম রিদওয়ানুল্লাহি তাআলা আজমাঈন। তাঁদের মধ্যে নবী প্রেমে একাধারে বিভোর ছিলেন খলিফাতুর রাসুল (দ.) হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.), ওমর ফারুক (রা.), ওসমান গণী (রা.) ও মওলা আলী (রা.)। উনাদের জীবনীর দিকে যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি দেখতে পাই উনারা একেক জন আশেকে রসুল (দ.) ছিলেন এবং নবীর প্রতি ভালবাসার কারণে তাদের এই মকাম অর্জিত হয়েছিল। প্রিয় নবীর মহব্বতে সাহাবায়ে কেরামগণ তাঁদের ধন সম্পদ এমনকি জীবন সহ সবকিছু উৎসর্গ করেছেন ।


প্রিয় নবীর ভালোবাসার তাগিদ ও নির্দেশনা শুধু তাঁর উম্মতের জন্য নয় পূর্ববর্তী নবীগণের উপরও ছিল । উদাহরণ স্বরুপ আমি শুধু একজন নবীর কথা বলব যিনি উম্মতে মোহাম্মদীর কাছে বেশি পরিচিত। তাঁর নাম হযরত মুসা (আ.)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, যখন হযরত মুসা (আ.) বললেন, হে আমার প্রভু আপনি আমাকে এত বড় নেয়ামতের মকাম দান করেছেন যাহা ইতোপূর্বে অন্য কারো অর্জন হয়নি। তখন আল্লাহ তা'আলা বললেন, হে মুসা আমি তোমার অন্তরকে বিনয়াবনত পেয়েছি তাই তোমাকে এই মকাম আমি দান করেছি। অতএব-


আমি তোমাকে যাহা দিয়েছি তাহা গ্রহণ কর এবং তুমি কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হও এবং তুমি তাওহিদ তথা একত্ববাদে বিশ্বাসী হও এবং হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর ভালবাসার উপর মৃত্যুবরণ করিও। (সুবহানাল্লাহ)। তখন হযরত মুসা (আ.) আরজ করলেন, হে মাবুদ তোমার তাওহিদের সাথে কি মুহাম্মদ (দ.)-এর মহব্বত জরুরী? তখন আল্লাহ তা'আলা বলেন-


لولا محمد وأمته لما خلقت الجنة ولا النار ولا الشمس ولا القمر ولا الليل ولا النهار ولا ملكا مقربا ولا نبيا مرسلا ولا اياك


অর্থাৎ- যদি মোহাম্মদ (দ.) ও তাঁর উম্মতগণকে আমি সৃষ্টি না করতাম তাহলে আমি জান্নাত, দোযখ, সূর্য্য, চন্দ্র, রাত, দিন, মোকাররবিন ফেরেশতাগণ এবং কোন নবী রাসূল সৃষ্টি করতাম না। এমনকি তুমি মুসা (আ:)-কেও সৃষ্টি করতাম না। (সুবহানাল্লাহ) (বারা তাকরিরি কৃত আল্লামা মুফতি মোহাম্মদ শরীফ সাহেব, পৃ. নং-১২৮)

এবার আসুন প্রিয় নবী (দ.) এর মহব্বত সম্পর্কে কিছু হাদীস শরীফ শুনি-

(১)

عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يؤمن اكون احب اليه من والده وولده والناس أجمعين - رواه أحدكم حتى


অর্থ্যাৎ- হযরত আনাছ (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (দ.) ইরশাদ ফরমান তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবেনা যতক্ষণ তার নিকট আমি নবী তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং দুনিয়ার সমস্ত মানুষ হতে অধিক প্রিয়তর না হই। (বুখারী ও মুসলিম)

(২)

عن عبد الله بن هشام رضي الله عنه قال: كنا مع النبي صلى الله عليه وسلم وهو آخذ بيد عمر بن عمر بن الخطاب رض فقال له عمر رض يا رسول الله صلى الله عليه وسلم لانت احب الي من كل شيء إلا من نفسي فقال النبي صلى الله عليه وسلم لا والذي نفسي بيده حتى أكون أحب إليك من نفسك فقال له عمر (رض): فإنه الآن والله لأنت احب الي من نفسي فقال


সারমর্ম- হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, হে আল্লাহর রসুল (দ.), নিশ্চয় আপনি আমার নিকট আমার জান ব্যতিত দুনিয়ার সকল বস্তু হতে অধিক প্রিয়। তখন রসুল (দ.) বললেন- না, ঐ খোদার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আমি নবী তোমার নিকট তোমার জানের থেকেও প্রিয় হতে হবে। তখন ওমর (রা.) বললেন, নিশ্চয় এখন এটাই হল। আল্লাহর কসম হে রাসুল (দ.), অবশ্যই আপনি আমার নিকট আমার জান হতে ও অধিক প্রিয় । অতঃপর রসুল (দ.) বললেন- এখন ঠিক বলেছ হে ওমর। (বুখারী-হাদিস নং 6632)

সুতরাং উপরোক্ত হাদীস হতে প্রতীয়মান হয় যে, দয়াল নবীকে উম্মত তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতে হবে ৷ অন্যথায় ঈমানের পূর্ণতা আসবে না ।


(৩)

عن انس (رض) ان رجلا اتي النبي صلي الله عليه وسلم فقال متى الساعة يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ؟ قال ما أعددت لها ؟ قال ما أعددت لها من كثير صلاة ولا صوم ولا صدقة، ولكني أحب الله ورسوله قال: أنت مع من أحببت

অর্থ্যাৎ হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় একজন ব্যক্তি নবী করিম (দ.) এর দরবারে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসুল (দ.), কেয়ামত কখন হবে? তখন রসুল (দ.) বললেন, তুমি কিয়ামতের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ? তখন তিনি বললেন- আমি কিয়ামতের জন্য বেশি নামাজ, রোজা এবং সদকা জোগাড় করতে পারি নাই কিন্তু আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (দ.)-কে বেশি ভালবাসি। তখন রসুল (দ.) বললেন- তুমি যাকে বেশি ভালবাস তার সাথে তোমার হাশর হবে। (সুবহানাল্লাহ)-বুখারী (৩৬৮৮), মুসলিম (২৬৩৯)


(৪) অপর হাদিসে এসেছে-

من أحبني كان معي في الجنة كما رواه أنس رض

দয়াল নবী ইরশাদ করেছেন, যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।


(৫) অপর হাদিসে এসেছে- হযরত সফওয়ান বিন কুদামা (রা.) বলেন- হে আল্লাহর রাসুল (দ.), আমি আপনাকে ভালবাসি । 

প্রিয় নবী (দ.) তাঁকে বলেন-

المرء مع من احب

মানুষ যাকে ভালবাসে তার সঙ্গেই সে থাকে। অর্থ্যাৎ হে সফওয়ান, তুমি যেই নবীকে ভালবাস সেই নবীর সাথে কবরে, হাশরে ও জান্নাতে সঙ্গী হয়ে থাকবে। সুবহানাল্লাহ! (শিফা শরিফ, পৃ.নং-২৭৩)


এই হাদিস একই অর্থে নবিজীর সুপ্রসিদ্ধ অনেক সাহাবী বর্ণনা করেছেন। যেমন-আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.), আবু এইভাবে অসংখ্য হাদিস শরীফ মুহাদ্দিসিনে কেরামগণ বর্ণনা মুসা (রা.), আনাস (রা.) ও আবু জর (রা.) প্রমুখ।

করেছেন যাহা গণনা বা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সরাসরি অধ্যায় রচনা করেছেন- এমনকি ইমাম বুখারি (র.) স্বীয় কিতাব বুখারী শরীফে

باب حبّ النبي صلى الله عليه وسلم من الإيمان


অর্থ্যাৎ নবীর ভালবাসাই হচ্ছে ঈমান । অনুরুপভাবে প্রত্যেক হাদিসের কিতাবেই মুহাদ্দেসীনে কেরামগণ নবীর ভালবাসার উপর পৃথক পৃথক অধ্যায় তৈরি করেছেন। যাহা ঈমানদারের জন্য নিশ্চয় অতি গুরুত্ববহ। অন্যথায় এত গুরুত্ব প্রদানের অর্থ কি হতে পারে? এবার আসুন যদি আউলিয়ায়ে কেরামগণের দিকে আমরা একটু তাকাই দেখতে পাব প্রত্যেক তরিকতের পীর মাশায়েখগণ তাদের মুরিদান ও ভক্তবৃন্দদেরকে তরিকতের শিক্ষার পাশাপাশি নবীর তাজিম, তাওকির, প্রেম, ভালবাসার শিক্ষা ও দিয়েছেন। ওয়াইছিয়া তরিকতের ছবকই হচ্ছে- শুধু নবীর প্রেমের নাম ধর্ম ও ভালবাসার নাম ঈমান ।


তাইতো ইমামে আহলে সুন্নাত গাজীয়ে দ্বীন ও মিল্লাত আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) এর অমিয় বাণি - “মাই তো বিমারে নবী হো” যিনি আজীবন এদেশের মানুষকে নবী প্রেমের শিক্ষা দিয়েছেন। যার কারণে এদেশের পুরো সুন্নি জনতা আজ পর্যন্ত উনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে যাচ্ছে। অদিকে ইমাম আহমদ রেজা খান ফাযেলে বেরেলভী (রহ.) ছিলেন নবী প্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। যার লিখনির প্রত্যেকটি কলামে নবি প্রেমের জ্যোতি ছড়ায়। 


নবী (সাঃ) প্ৰেমে খোদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত

যিনি প্রিয় নবীর ভালবাসায় নিজেকে এত বেশি বিলীন করেছিলেন যে, ঘুমানোর সময় যখন তিনি শয়ন করতেন তখন হুবহু প্রিয় নবীর নাম মোবারক এর আদলে শয়ন করতেন। এটা প্রিয় নবীর প্রেম ও ভালোবাসায় করতেন।


পরিশেষে বলব হাজারো দৃষ্টান্ত ও নমুনা কিতাবে উল্লেখিত রয়েছে। আমি আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কবির একটি পংক্তি উল্লেখ করে শেষের দিকে যাচ্ছি,


যার অন্তরে নবীর প্রেম ভালবাসা অর্জন হয়নি সে যতবড় মুমিনের দাবিদার হোক না কেন, তার ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। একথাও মনে রাখতে হবে, যে নবীকে ভালবাসেন তার কথা, বক্তব্য, লিখনী সবকিছু সর্বদা নবীর পক্ষেই হবে। সে এমন কিছু করবেনা বা বলবেনা যাতে করে প্রিয় নবীর মানহানি হয় এবং প্রিয় নবী কষ্ট পায়। যারা প্রিয় নবীকে ভালবাসেন তাদের চিনার আলামত বা চিহ্ন হল তারা বেশি বেশি প্রিয় নবীর স্মরণ ও আলোচনা করবে। যেমনটি ইমাম কাজী আয়াজ (রহ.) বর্ণনা করেছেন-

 علامات محبة النبي صلى الله عليه وسلم كثرة ذكره له فمن أحب شيئا أكثر ذكره ومنها كثرة شوقه إلى لقائه، فكل حبيب يحب لقاء حبيبه


নবীর প্রেমিকদের চিহ্ন বা আলামত হলো তারা বেশি বেশি প্রিয় নবীর দিদার বা সাক্ষাত কামনা করবে। প্রত্যেক বন্ধু তার বন্ধুর সাক্ষাৎ চায়।

Post a Comment

0 Comments