Ticker

10/recent/ticker-posts/

ঈমান সবার আগে==মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া, ঢাকা

👇ঈমান সবার আগে👇

🔰বই ডাউনলোড করুন🔰

রচনা

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক আমীনুত তা'লীম, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া, ঢাকা খতীব, শান্তিনগর আজরুন কারীম জামে মসজিদ, ঢাকা তত্ত্বাবধায়ক, মাসিক আল কাউসার, ঢাকা


بسم الله الرحمن الرحيم

🔰ঈমান সবার আগে🔰

أنفسنا ومن سيئات إن الحمد الله، نحمده ونستعينه ونستغفره، ونعوذ بالله من شرور أ فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له، وأشهد أن لا إله إلا الله الله أعمالنا، من يهده ا وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله. أما بعد،


সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হল ঈমান। ঈমানের বিপরীত কুফর। ঈমান সত্য, কুফর মিথ্যা। ঈমান আলো, কুফর অন্ধকার। ঈমান জীবন, কুফর মৃত্যু। ঈমান পূর্ণ কল্যাণ আর কুফর পূর্ণ অকল্যাণ। ঈমান সরল পথ, আর কুফর ভ্রষ্টতার রাস্তা।


ঈমান মুসলমানের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ঈমানদার সকল কষ্ট সহ্য করতে পারে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, কিন্তু ঈমান ছাড়তে পারে না । ঈমানই তার কাছে সবকিছু থেকে বড়। ঈমান শুধু মুখে কালেমা পড়ার নাম নয়, ইসলামকে তার সকল অপরিহার্য অনুষঙ্গসহ মনেপ্রাণে কবুল করার নাম। আর একারণে মুমিনকে হতে হবে সুদৃঢ়, সত্যবাদী ও সত্যনিষ্ঠ ।

মুমিন কখনো শৈথিল্যবাদী হতে পারে না। কুফরির সাথে যেমন তার সন্ধি হতে পারে না তেমনি মুরতাদ ও অমুসলিমের সাথেও বন্ধুত্ব হতে পারে না।


ইসলামের পূর্ণ পরিচয় কী এবং তার অপরিহার্য দাবি ও অনুষঙ্গগুলোই বা কী? সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।


দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে বেপরোয়া লোকদের যেহেতু এইসব বিষয়ের জ্ঞান নেই, কিংবা জ্ঞান থাকলেও পরোয়া নেই তাই তাদের মতে ঈমান- কুফরের সন্ধিও অসম্ভব কিছু নয়। (লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম)


কাকে বলে ঈমান আর তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ কী- এ সম্পর্কে নিচে আলোকপাত করা হল ।


১. ঈমান ওহীর মাধ্যমে জানা সকল সত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করার নাম অজ্ঞতা-অনুমান আর কল্পনা-কুসংস্কারের কোনো অবকাশ ঈমানে নেই। ঈমান ঐ সত্য সঠিক আকীদাকে স্বীকার করা এবং সত্য বলে বিশ্বাস করার নাম, যা আসমানী ওহীর দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।

যে ওহী ‘আল কুরআনুল কারীম' এবং ‘আস্সুন্নাতুন নাবাবিয়্যাহ' রূপে এখনো সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে ইনশাআল্লাহ ।


২। ঈমান অবিচল বিশ্বাসের নাম

ঈমান তো অবিচল ও দৃঢ় বিশ্বাসের নাম। সংশয় ও দোদুল্যমানতার মিশ্রণও এখানে হতে পারে না। সংশয়ই যদি থাকে তবে তা ‘আকীদা কীভাবে হয়'?

বিশ্বাস যদি দৃঢ়ই না হয় তবে তা ঈমান কীভাবে হয়'? 


কুরআন মজীদের ইরশাদ-

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ للصَّادِقُونَ


তারাই মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, পরে সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই সত্যনিষ্ঠ।-আলহুজুরাত ৪৯ : ১৫


সংশয় ও দোদুল্যমানতা কাফির ও মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য, মুমিনের নয় । 


ইরশাদ হয়েছে—

لَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ ● إِنَّمَا يَسْتَأْذِنُكَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُوبُهُمْ فَهُمْ فِي رَبِّبِهِمْ يَتَرَدُّدُونَ


যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনে তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদে অব্যাহতি পাওয়ার প্রার্থনা তোমার নিকট করে না। আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। তোমার নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা শুধু ওরাই করে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান আনে না এবং যাদের চিত্ত সংশয়যুক্ত। ওরা তো আপন সংশয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ।-আত তাওবা ৯ : ৪৪-৪৫


৩। কোনো বিষয়কে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে মেনে নেয়ার নাম ঈমান


ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোকন হল, কোনো বিষয়কে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে মেনে নেয়া ও বিশ্বাস করা। স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর ঈমান আনার আর কী থাকে?

চোখে দেখা বিষয়কে কে অস্বীকার করে ?


ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও দৃশ্যমান বস্তুসমূহ বা সাধারণ বিবেক বুদ্ধি দ্বারা বোঝা যায় এমন বিষয়সমূহ ঈমানের বিষয়বস্তু হতে পারে না। এসব তো মানুষ এমনিতেই মেনে নেয়। এতে ঈমান আনা না আনার প্রশ্নই অবান্তর ।


দেখা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনের নাম ঈমান নয়। মুমিনকে তো এজন্য মুমিন বলা হয় যে, সে না দেখা বিষয় শুধু আল্লাহ বা তাঁর রসূলের সংবাদের উপর ভিত্তি করে মেনে নিয়েছে ও বিশ্বাস করেছে।


দাহরিয়ারা বলে, “স্বচক্ষে দেখা ছাড়া আমরা কিছু মানি না।' আর যুক্তিপূজারীরা বলে, ‘যা বিবেক বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না তা আমরা মানি না।' পক্ষান্তরে মুমিন বলে, ‘সত্য সংবাদদাতার সংবাদ মেনে নেওয়া সুস্থ বিবেকেরই ফয়সালা।'


তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী পৌছার পর তা গ্রহণ করতে বিলম্ব করার কোনোই অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের শুরুতেই মুমিনের গায়েবে বিশ্বাস করার এই গুণ-বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করে বলেছেন-


الم . ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ . الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ . وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ . أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ


আলিফ লাম মীম, এটি সেই কিতাব। এতে কোনো সন্দেহ নেই । এটা হেদায়াত এমন ভীতি অবলম্বনকারীদের জন্য-


যারা অদৃশ্য জিনিসসমূহের প্রতি ঈমান রাখে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর সন্তোষজনক কাজে) ব্যয় করে।


এবং যারা ঈমান রাখে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতেও এবং তারা আখিরাতে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে। এরাই এমন লোক, যারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে সঠিক পথের উপর আছে এবং এরাই এমন লোক, যারা সফলতা লাভকারী।-সূরা বাকারা (২) : ১-৫


যে ব্যক্তি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত অদৃশ্যের বিষয় মেনে নিতে এ জন্য সন্দিহান থাকে যে, সে সকল বিষয়ের ধরণ ও বিস্তারিত বিবরণ তার বুঝে আসছে না। অথবা শরীয়তের কোনো হুকুম কবুল করতে এজন্য দ্বিধাগ্রস্ত যে তার এই হুকুমের হেকমত বুঝে আসছে না। অথবা কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত কোনো বিষয়ে সে এজন্য সন্দেহ পোষণ করে যে, সে বিষয়ে কোনো বিজ্ঞানীর সাক্ষ্য নেই । এ সকল লোক আসলে ঈমানের হাকীকতই বোঝে না ৷


তাদেরকে কে বোঝাবে যে, যে বিষয়টি আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন অথবা আকলের মাধ্যমে অনুধাবন করেছেন অথবা আপনার কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তি আপনাকে খবর দিয়েছে ফলে আপনি তা বিশ্বাস করেছেন; তাহলে এটা ‘ঈমান কীভাবে হয়? !


আপনার এ মেনে নেয়া তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কথার উপর নির্ভর করে হয়নি। (দেখা, বোঝা বা অন্য কারো উপর নির্ভর করে হয়েছে।) ঈমান তো তখন ঈমান বলে গণ্য হবে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আপনার আস্থা ও নির্ভরতা থাকবে। যার প্রতি আস্থা ও নির্ভরতাই নেই তার উপর ঈমানের দাবি কীভাবে হয়?


আল্লাহর দেওয়া ইলমে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত গায়েবের প্রতি ঈমানের নেয়ামত থেকে যারা মাহরূম তারা ঈয়াকীনী ইলম (নিশ্চিত জ্ঞান) ছেড়ে নিছক ধারণা, অনুমান এবং খেয়াল খুশির পিছনে ছুটে বেড়ায় এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যিনি ‘আসদাকুল কু-ইলীন’, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি ‘আস সাদিকুল মাসদৃক' এবং ‘আস সাদিকুল আমীন' তাঁদের সংবাদের উপর নির্ভর না করে না বুঝে না দেখে এমন অনেকের কথা মেনে নেয় যাদের কাছে না আছে গায়েবের ইলম না তাদের বিশ্বস্ততা সন্দেহাতীত। নেয়ামতের কদর না করলে এটাই হয় পরিণাম।


৪. ঈমান সত্যের সাক্ষ্যদান এবং আরকানে ইসলাম পালনের নাম অন্তরের বিশ্বাসের সাথে মুখেও সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া ঈমানের অন্যতম রোকন। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবীআ গোত্রের প্রতিনিধিদলকে এক আল্লাহর উপর ঈমান আনার আদেশ করার পর জিজ্ঞাসা করেছিলেন-


أتدرون ما الإيمان بالله وحده ؟ قالوا : الله ورسوله أعلم، قال : شهادة أن لا إله إلا الله، وأن محمدا رسول الله، وإقام الصلاة وإيتاء الزكاة وصيام رمضان، وأن تعطوا من المغنم الخمس.


তোমরা কি জান ‘এক আল্লাহর উপর ঈমান' কাকে বলে? তারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (এক আল্লাহর উপর ঈমান আনার অর্থ) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই। মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। আর সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানের রোযা রাখা ও গণীমতের এক পঞ্চমাংশ প্রেরণ করা।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩, কিতাবুল ঈমান, আদাউল খুমুসি মিনাল ঈমান হকের সাক্ষ্য দেওয়া মুমিনের পরিচয়।

মুমিন কখনো সত্য গোপন করে না অর্থাৎ সত্যকে জেনেও তা স্বীকার করা থেকে বিরত থাকে না। কখনো মিথ্যা ও অবাস্তব সাক্ষ্যও দেয় না। অসত্য ও অবাস্তবের সাক্ষ্য দেওয়া তো কাফির মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। মুমিন তো এমন সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করে ।


شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ • إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اختَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ ، فَإِنْ حَاجُّوكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ وَقُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ • إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ حَقٌّ وَيَقْتُلُونَ الَّذِينَ يَأْمُرُونَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ . أُولَئِكَ الَّذِينَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ


আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও; আল্লাহ ন্যায়নীতিতে প্রতিষ্ঠিত, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় ।


🔰* নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তো পরস্পর বিদ্বেষবশত তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই মতানৈক্য ঘটিয়েছিল। আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে অস্বীকার করলে আল্লাহ তো হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর ।


🔰* যদি তারা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তবে তুমি বল ‘আমি আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করেছি এবং আমার অনুসারীগণও'। আর যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বল, ‘তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ'? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পেয়েছে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমার কর্তব্য তো শুধু প্রচার করা । আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা ।


🔰* যারা আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করে, অন্যায়রূপে নবীদেরকে হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়ের নির্দেশ দেয় তাদেরকে হত্যা করে, তুমি তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও ।


🔰* এসব লোকদের কার্যাবলী দুনিয়া ও আখেরাতে নিষ্ফল হবে এবং তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই।-আলে ইমরান ৩ : ১৮-২২


قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهَادَةً قُلِ اللهُ شَهِيدٌ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لِأَنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَنَعَ أَيْنَكُمْ لَتَشْهَدُونَ أَنَّ مَعَ اللهِ آلِهَةً أُخْرَى قُلْ لَا أَشْهَدُ قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلَهُ وَاحِدٌ وَإِنَّنِي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ . الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمُ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ


বল, “সাক্ষ্য দানে সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিস কী? বল, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী এবং এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট এটা পৌছবে তাদেরকে এর দ্বারা সতর্ক করি। তোমরা কি এই সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহও আছে? বল, ‘আমি সে সাক্ষ্য দেই না' । বল, তিনি তো এক ইলাহ এবং তোমরা যে শরীক কর তা হতে আমি অবশ্যই নির্লিপ্ত।

আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেইরূপে চিনে যেইরূপ চিনে তাদের সন্তানগণকে। যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, তারা বিশ্বাস করবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করে অথবা তার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে? নিশ্চিত জেনে রাখ, জালিমরা সফলতা লাভ করতে পারে না।-আল আনআম ৬ : ১৯-২১


৫। ঈমান অর্থ সমৰ্পণ

ঈমান আনার অনিবার্য অর্থ, বান্দা নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করবে। তাঁর প্রতিটি আদেশ শিরোধার্য করবে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আর আল্লাহর বিধানে আপত্তি একত্র হতে পারে না। রাসূলের প্রতি ঈমান আর তাঁর আদর্শের উপর আপত্তি, কুরআনের প্রতি ঈমান আর তার কোনো আয়াত বা বিধানের উপর আপত্তি কখনো একত্রিত হয় না ।


মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমর্পণ আর ইবলীস ও তার অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য বিপরীত যুক্তি। এখন তো শুধু আপত্তি বা বিপরীত যুক্তিই নয়, রাসূল, কুরআন ও ইসলামের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহকারীকেও মুসলমান মনে করা হয়। কারো প্রতি ঈমান, অতপর তার বিরুদ্ধতা এ দুটো একত্র হওয়া অসম্ভব হলেও ‘অসহায়' ইসলামের ব্যাপারে বর্তমানের 'বুদ্ধিজীবীদের কাছে তা পুরাপুরিই সম্ভব। বুদ্ধিমান মানুষমাত্রই জানেন, ইসলামবিহীন তথা সমর্পণবিহীন ঈমানের কথা কল্পনাও করা যায় না। আর না তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এ তো ঈমানের সাথে সরাসরি বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।


وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِ الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ  إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمُ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ . وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ


যে নিজেকে নির্বোধ করেছে সে ব্যতীত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ হতে আর কে বিমুখ হবে। পৃথিবীতে তাকে আমি মনোনীত করেছি; আর আখেরাতেও সে অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণগণের অন্যতম। 


🔰* তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর। সে বলেছিল, জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। * এবং ইবরাহীম ও ইয়াকুব এই সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দ্বীন মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী না হয়ে তোমরা কখনো মৃত্যুবরণ করো না।-আল বাকারা ২ : ১৩০-১৩২


قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ، قُلْ إِنْ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ . لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ


🔰* বল, আমার প্রতিপালক তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সেটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন, ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে . মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না ।


🔰* বল, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আমি তাঁর সম্মুখে সর্বপ্রথম মাথানতকারী।-আল আনআম ৬ : ১৬১-১৬৩

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ


🔰* হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না ৷—আলে ইমরান ৩: ১০২


৬. ঈমান শরীয়ত ও উসওয়ায়ে হাসানাকে গ্রহণ করার নাম।

ইসলামকে শুধু সত্য ও সুন্দর জানা বা বলার নাম ঈমান নয়। কারণ, হক ও সত্যকে শুধু জানা বা মুখে বলা ঈমান সাব্যস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় । ঈমান তো তখনই হবে যখন এই সত্যকে মনেপ্রাণে কবুল করবে এবং এর সম্পর্কে অন্তরে কোনো দ্বিধা থাকবে না। ইসলাম তো ‘আকীদা' ‘শরীয়ত’—এ দুইয়ের সমষ্টির নাম। এ দুটোর বিশ্বাস এবং মেনে নেওয়ার দ্বারাই ঈমান সাব্যস্ত হতে পারে। ‘শরীয়ত' অর্থ, দ্বীনের বিধিবিধান ও ইসলামী জীবনের নবী-আদর্শ, কুরআন যাকে মুমিনের জন্য উসওয়ায়ে হাসানা সাব্যস্ত করেছে-


فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا


কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে মেনে নেয়। আন নিসা ৪ : ৬৫


أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ أَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلُّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ، وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا


তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচার প্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়? 


🔰* তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে। আন নিসা ৪ : ৬০-৬১


ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ، إِنَّهُمْ لَنْ يُعْنُوا عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا وَإِنْ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ . هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ


এরপর আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের বিশেষ শরীয়তের উপর সুতরাং তুমি তার অনুসরণ কর, অজ্ঞদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না । 


🔰* আল্লাহর মুকাবেলায় তারা তোমার কোনোই উপকার করতে পারবে না; জালিমরা একে অন্যের বন্ধু; আর আল্লাহ তো মুত্তাকীদের বন্ধু । 


🔰* এই কুরআন মানবজাতির জন্য সুস্পষ্ট দলীল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত। আল জাছিয়া ৪৫ : ১৮-২০


৭. ঈমান শুধু গ্রহণ নয়, বর্জনও, সত্যকে গ্রহণ আর বাতিলকে বর্জন।


কোনো আকীদাকে মেনে নেওয়ার পাশাপাশি তার বিপরীত বিষয়কেও সঠিক মনে করা স্ববিরোধিতা। মানবের সুস্থ বুদ্ধি তা গ্রহণ করতে পারে না। ইসলামেও তা অগ্রহণীয়। ঈমান তখনই সাব্যস্ত হবে যখন বিপরীত সব কিছু বাতিল ও মিথ্যা মনে করবে এবং তা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। সকল প্রকারের শিরক ও কুফর থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করা সরাসরি ঈমানেরই অংশ।

যেমন ঈমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাওহীদ। তাওহীদ কি শুধু আল্লাহ তাআলাকে মাবুদ মানা? না তা নয়। তাওহীদ অর্থ একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে সত্য মাবুদ বলে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বা কোনো কিছুকে মাবুদ বলে স্বীকার না করা। তাওহীদ অর্থ, আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করা, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত না করা।

তাওহীদ অর্থ, উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বের বিষয়ে শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য না চাওয়া। তাওহীদের অর্থ, একমাত্র আল্লাহকেই কল্যাণ-অকল্যাণের, হায়াত মওতের মালিক মনে করা, অন্য কাউকে এসব বিষয়ে ক্ষমতাশালী মনে না করা।

তাওহীদ অর্থ, শুধু আল্লাহকে আহকামুল হাকিমীন মনে করা, আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কারো হুকুম স্বীকার না করা, তাওহীদ অর্থ, শুধু শরীয়তে মুহাম্মাদিয়ার আনুগত্যকেই অপরিহার্য মনে করা, অন্য কোনো শরীয়তের আনুগত্য বৈধ মনে না করা। তাওহীদ অর্থ, শুধু ইসলামকেই হক্ব ও সত্য মনে করা, অন্য কোনো দ্বীনকে হক্ব ও সত্য মনে না করা।


মোটকথা, সব জরুরিয়াতে দ্বীন (দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়) এবং অকাট্য আকীদা ও আহকাম এই প্রকারেরই অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ে ঈমান তখনই সাব্যস্ত হবে যখন তার বিপরীত বিষয়কে বাতিল ও মিথ্যা বলে বিশ্বাস করা হবে। আর তা থেকে ‘তাবাররি' (সম্পর্কহীনতা) অবলম্বন করা হবে। এ সব তো ‘মুজতাহাদ ফী' (যাতে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে একাধিক মত হতে পারে) বা ‘তানাওউয়ে সুন্নত' (যাতে একাধিক সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি রয়েছে)-এর ক্ষেত্র নয় যে, বিপরীত দিকটিকেও গ্রহণযোগ্য বা নীরবতার যোগ্য মনে করা যায়।


আজকাল দ্বীন ও ঈমানের বিষয়ে যেসব বিপদ ও ফিত্নার ব্যাপক বিস্তার ঘটছে তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ফিত্না এটাই যে, জরুরিয়াতে দ্বীন, মৌলিক আকীদা ও ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়াদিকেও একাধিক মতের সম্ভাবনাযুক্ত বিষয়াদির মতো মত প্রকাশের ক্ষেত্র বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ এগুলো হচ্ছে হুবহু মেনে নেওয়ার বিষয়। এগুলো তো 'ধারণা' ও ‘মতামত’ প্রকাশের ক্ষেত্রই নয়। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র সেটিই সত্য, যা কুরআন মজীদ, সুন্নতে মুতাওয়ারাছা (গোটা মুসলিম উম্মাহর মাঝে সর্বযুগে প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ) ও ইজমার দ্বারা প্রমাণিত।


এখানে বিপরীত দিকগুলোর কোনো অবকাশই নেই। সেগুলো নিঃসন্দেহে বাতিল ও ভ্রান্ত। এই হক ও সত্যকে গ্রহণ করা এবং সকল বিরোধী মত, চিন্তা ও দর্শন, যা নিঃসন্দেহে বাতিল ও ভ্রান্ত, তা থেকে তাবারি (সম্পর্কহীনতা) অবলম্বনের নাম ঈমান।


ইবরাহীম আ. তাঁর কওমকে বলেছিলেন :


إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ .وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ


“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।


🔰* আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই ।- আল আনআম ৬ : ৭৮-৭৯


হৃদ আ. তার কওমের উত্তরে বলেছিলেন—

إِنِّي أُشْهِدُ اللهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ • مِنْ دُونِهِ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنْظِرُونِ إِنِّي تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ رَبِّي وَرَبِّكُمْ مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ أَخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّي عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ


আমি তো আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষী হও যে, নিশ্চয়ই 


🔰* আল্লাহ আমি তা হতে মুক্ত, যাকে তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক কর, ব্যতীত তোমরা সকলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর, অতঃপর আমাকে অবকাশ দিয়ো না। 


🔰* আমি নির্ভর করি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপর; এমন কোনো জীবজন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক আছেন সরল পথে।-হৃদ ১১ : ৫৪-৫৬ 

সূরায়ে মুমতাহিনায় বলা হয়েছে-


قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَاءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ . رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةٌ لِلَّذِينَ كَفَرُوا وَاغْفِرْ لَنَا رَبَّنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ . لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيهِمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو الله وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَمَنْ يَتَوَلُ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ


🔰* তোমার জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, 'তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই । আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন', তবে ব্যতিক্রম তার পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তি-আমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব; এবং তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি কোনো অধিকার রাখি না ।


হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনারই উপর নির্ভর করেছি, আপনারই দিকে আমরা রুজু হয়েছি এবং আপনারই কাছে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ।


হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে কাফেরদের পরীক্ষার পাত্র বানাবেন না এবং হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই কেবল আপনিই এমন, যার ক্ষমতা পরিপূর্ণ, হেকমতও পরিপূর্ণ ।


(হে মুসলিমগণ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য তাদের (কর্মপন্থার) মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ, প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্য, যে, আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে। আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে (সে যেন মনে রাখে), আল্লাহ সকলের থেকে মুখাপেক্ষীতাহীন, আপনিই প্রশংসার্হ।-সূরা মুমতাহিনা ৬০ : ৪-৬


কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা হারাম । এরপরও ইবরাহীম আ. আযরের জন্য কেন দুআ করেছেন-তার জবাব স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবায় দিয়েছেন—


مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنْ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهُ حَلِيمٌ


🔰* আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও মুমিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই ওরা জাহান্নামী।

🔰* ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন এটা তার নিকট স্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল ।-আত তাওবা ৯ : ১১৩-১১৪


ইসলাম ছাড়া অন্যসব ধর্ম ও মতবাদ থেকে এবং ইসলামের দুশমনদের থেকে তাবাররি (বিমুখতা ও সম্পর্কহীনতা) ঈমানের রোকন হওয়ার কারণ একমাত্র ইসলামই হক ও সত্য - إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ


অর্থাৎ আল্লাহর কাছে দ্বীন একমাত্র ইসলামই ।-আলে ইমরান ৩ : ১৯


رَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي


🔰* কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না, এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।-আলে ইমরান ৩ : ৮৫


মোটকথা, লা-দ্বীনী (ধর্মহীনতা) যেমন কুফর তেমনি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অন্বেষণ করাও কুফর। হক ও সত্য আকীদাসমূহ গ্রহণ করা আর কুফরী কর্ম ও বিশ্বাস থেকে সম্পর্কহীনতা অবলম্বন করা—এ দুয়ের সমষ্টির দ্বারা ঈমান অস্তিত্ব লাভ করে। ঈমান ও ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় একত্র হবে কীভাবে? এ তো অজু ভঙ্গের কারণ বিদ্যমান থাকার পরও অজু আছে বলে দাবি করার মতো। এটা যেমন সম্ভব নয়, ওটাও সম্ভব নয় ।


৮। আস্থা-ভালবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা ছাড়া ঈমান হয় না; বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা অস্বীকারের চেয়েও ভয়াবহ কুফর


কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রতি ঈমান তখনই হতে পারে যখন তার উপর থাকে পূর্ণ আস্থা, অন্তরে তাঁর প্রতি থাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল, তাঁর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব, তাঁর বিধান ও শরীয়ত এবং তাঁর দ্বীনের সকল নিদর্শনের সাথে মুমিনের সম্পর্ক ঐ আস্থা-বিশ্বাস এবং ভক্তি- শ্রদ্ধারই সম্পর্ক ।


যার প্রতি বা যে বিষয়ে ঈমান আনা হয়েছে তার প্রতি বা ঐ বিষয়ে আস্থা-বিশ্বাস এবং ভক্তি-ভালবাসাই হচ্ছে ঈমানের প্রাণ। চিন্তা-ভাবনা এবং আমল ও আলোচনার দ্বারা একে শক্তিশালী করা এবং গভীর থেকে গভীরতর করা প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব।


বিদ্বেষ ও ঈমান একত্র হওয়া অসম্ভব। যার প্রতি ঈমান থাকবে তার প্রতি ভালবাসাও থাকবে। পক্ষান্তরে যার প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা থাকবে তার প্রতি ঈমান থাকতে পারে না। অন্তরের বিদ্বেষ সত্ত্বেও যদি মুখে ঈমান প্রকাশ করে তবে তা হবে মুনাফিকী ।


মুসলমানের ভালবাসা হবে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর নেক বান্দাদের প্রতি। আর কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকের ভালবাসা হবে তাদের নিজ নিজ উপাস্য ও নেতাদের প্রতি ।

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حبا لِلَّهِ


তথাপি মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে; কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ভালবাসায় তারা সুদৃঢ়।-আলবাকারা ২ : ১৬৫


يحبهم ويحبو يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ. أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ . إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنْ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ


হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন হতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসেন এবং যারা তাঁকে ভালবাসেন; তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না; এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। 


🔰* তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, 


🔰* কেউ আল্লাহ, যারা বিনত হয়ে সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় । তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে।-আল মাইদা ৫ : ৫৪-৫৫


التي أولى بالمُؤمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ


নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর পত্নীগণ তাদের মাতা ।-আল আহযাব ৩৩ : ৬


إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا • لِتُؤْمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا


(হে রাসূল!) আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে (হে মানুষ) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলকে শক্তি যোগাও, তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।-আল ফাতহ ৪৮ : ৮-৯

হাদীসে বলা হয়েছে-

لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من ولده ووالده والناس أجمعين.


তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার সন্তান ও পিতা (মাতা)র চেয়ে এবং সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব।— সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৪; সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫

অন্য হাদীসে আছে—-


لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من نفسه.


তোমরা কেউ ঐ পর্যন্ত মুমিন হবে না, যে পর্যন্ত আমি তার কাছে তার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় না হই।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৮০৪৭; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৬৩২

সূরা তাওবায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে—


قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ


বল, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।-আত তাওবা ৯ : ২৪


আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর বিধানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য যে পর্যন্ত ঐ সকল ব্যক্তি, বস্তু ও মতবাদের আসক্তির উপর প্রাধান্য না পায়, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালবাসা ও আল্লাহর বিধানসমূহের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়, সে পর্যন্ত ব্যক্তিকে 'মুমিন' বলা হবে না, ‘ফাসিক' (কাফির) বলা হবে। আর যে এই কুফরের উপর অবিচল থাকবে সে কখনো হেদায়েত পাবে না ।


মোটকথা, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর দ্বীনের (ইসলামের) প্রতি অনুরাগ-ভালবাসাই হচ্ছে মুমিনের বৈশিষ্ট্য- আর এঁদের প্রতি বিরাগ-বিদ্বেষ কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য।


مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ


যে কেউ আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিবরীল ও মীকাঈলের শত্রু সে জেনে রাখুক, আল্লাহ নিশ্চয়ই কাফিরদের শত্রু ।

-আল বাকারা ২ : ৯৮


অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ বিরাগবিদ্বেষের চেয়েও হীন ও ভয়াবহ

ভদ্রতা ও মানবতার ছিটেফোঁটাও যার মধ্যে আছে তার কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা মতবাদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও কখনো সে হীনতা ও অশ্লীলতায় নেমে আসতে পারে না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা-বিদ্রূপ এবং কটূক্তি ও গালিগালাজের মতো নীচ কর্মে অবতীর্ণ হতে পারে না। কারণ এটা বিদ্বেষ ও শত্রুতা প্রকাশের চরম হীন উপায়। শরাফতের লেশমাত্র আছে এমন কেউ তা অবলম্বন করতে পারে না। যেহেতু ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম ভাই দুষ্কৃতিকারী ও ভ্রান্ত মতে বিশ্বাসীই এর শত্রু। এদের অতিমাত্রায় উগ্ৰ ও কট্টর শ্রেণীটি তাচ্ছিল্য, বিদ্রূপ ও অশ্লীল বাক্যের দ্বারা এই শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সকল যুগের উগ্র কাফির-মুশরিকের প্রবণতা এটাই ছিল। এদের যে শ্রেণীটি এ অসভ্যতাকে মুনাফিকীর আবরণে আবৃত রাখার চেষ্টা করেছে তারাও এতে সফল হতে পারেনি ।


এদের সাথে মুসলিম জনগণের আচরণ কী হবে এবং রাষ্ট্রপক্ষের আচরণ কী হবে তা আলাদা বিষয়। এখানে যে কথাটি বলতে চাই, তা এতই স্পষ্ট যে, বলারও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমরা এমন এক পরিবেশে বাস করি, মনে হয়, এই সুস্পষ্ট কথাটিও অনেকেরই জানা নেই বা উপলব্ধিতে নেই ।


তা এই যে, ইসলাম, ইসলামের নবী (কিংবা ইসলামের কোনো নিদর্শন সম্পর্কে কটূক্তিকারী, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কিংবা তাঁর কোনো বিধানের অবজ্ঞা ও বিদ্রূপকারী যদি মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়, মুখে কালিমা পাঠকারীও হয় তবুও সে কাফির ও মুসলমানের দুশমন। শরীয়তের পরিভাষায় এই প্রকারের কাফিরের নাম ‘মুনাফিক’, ‘মুলহিদ' ও যিনদীক । এই স্পষ্ট বিধান এখন এজন্যই বলতে হচ্ছে যে, আমাদের সমাজে এমন লোকদের কুফরী কর্মকাণ্ড থেকেও বারাআত (সম্পর্কহীনতা) প্রকাশ নিজের ঈমান রক্ষার জন্য অপরিহার্য মনে করা হয় না; বরং এদের সাথেও মুসলমানদের মতো আচরণ করা হয়, এদের প্রশংসা করা হয়, এদেরকে ‘জাতীয় বীরে’ পরিণত করার চেষ্টা করা হয়।


কুরআন মজীদ পাঠ করুন এবং স্বয়ং আল্লাহ তাআলার নিকট থেকেই শুনুন, ইসলাম, ইসলামের নিদর্শনের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক কেমন হয় আর কাফির-মুনাফিকের আচরণ কেমন হয়। এরপর ফয়সালা করুন, আপনি কাদের সাথে থাকবেন। কুরআন কারীমে আরো দেখুন, যারা ইসলামের সাথে, ইসলামের নবীর সাথে ও ইসলামের নিদর্শনসমূহের সাথে বিদ্রূপ করে, আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ফয়সালা কী।


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاء وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنتُمْ مُؤْمِنِينَ ، وَإِذَا نَادَيْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ اتَّخَذُوهَا هُزُوًا وَلَعِبًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْقِلُونَ


হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা তোমাদের দ্বীনকে হাসি-তামাশা ও ক্রীড়ার বস্তুরূপে গ্রহণ করে তাদেরকে ও কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং যদি তোমরা মুমিন হও তবে আল্লাহকে ভয় কর। 


🔰* তোমরা যখন সালাতের জন্য আহ্বান কর তখন তারা ওটাকে হাসি-তামাশা ও ক্রীড়ার বস্তুরূপে গ্রহণ করে। এটা এই জন্য যে, তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই।-আল মাইদা ৫ : ৫৭-৫৮


বোঝা গেল, নামাযের অবজ্ঞাকারী ও নামায থেকে বাধাদানকারী ঐ যুগেও ছিল, কিন্তু মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তাআলার বিধান, তোমরা কখনো তাদের কথায় কর্ণপাত করো না; বরং আল্লাহকেই সিজদা করতে থাক এবং তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে থাক ।


كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ


সাবধান! তুমি ওর অনুসরণ করো না, এবং সিজদা কর ও আমার নিকটবর্তী হও।-আল আলাক ৯৬ : ১৯


আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গায়রুল্লাহর সিজদায় এদের কোনো গাত্রদাহ নেই আর এতেও কোনো ক্ষোভ ও যন্ত্রণা নেই যে, এদের অন্তর (যা আল্লাহ তাআলারই মাখলুক) সর্বদা তাদের মিথ্যা উপাস্যদের, যেমন প্রবৃত্তি, কুফরী মতবাদসমূহ ও নিজেদের নেতা ও সর্দারদের) প্রতি সিজদাবনত । বিচার বুদ্ধির সঠিক ব্যবহার করলে এদের মনেও গায়রুল্লাহর সিজদায় ঘৃণা ও ক্ষোভ জাগত এবং তারা তা বর্জন করত। অতপর হৃদয় ও ললাট উভয়ের দ্বারাই নিজের মতো সৃষ্টির পরিবর্তে আপন স্রষ্টার সামনে সিজদাবনত হত । বান্দার জন্য তার প্রকৃত মাবুদের সামনে সিজদাবনত হওয়াই তো পরম সৌভাগ্য


দুনিয়াতে যে সিজদা থেকে বিমুখ থাকে কিংবা তার অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করে, আখিরাতে শত চেষ্টা করেও সে সিজদার সুযোগ পাবে না ।


يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ . خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ


স্মরণ কর, সেই দিনের কথা যেদিন ‘সাক' উন্মোচিত করা হবে, সেই দিন তাদেরকে আহ্বান করা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। 


🔰* তাদের দৃষ্টি অবনত, হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল তখন তো তাদেরকে আহ্বান করা হয়েছিল সিজদা করতে।-আল কলম ৬৮ : ৪২-৪৩


মুনাফিকরা একদিকে কুরআন, ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করে অন্যদিকে মুসলমানদের থেকে তা গোপন করারও চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তা প্রকাশ করেই দেন।


يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوا إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَا تَحْذَرُونَ . وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ . لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةٌ بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ


মুনাফিকরা ভয় করে, তাদের সম্পর্কে এমন এক সূরা না অবতীর্ণ হয়, যা তাদের অন্তরের কথা ব্যক্ত করে দিবে। বল, বিদ্রূপ করতে থাক; তোমরা যা ভয় কর আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন। 


🔰* এবং তুমি তাদেরকে প্রশ্ন করলে তারা নিশ্চয়ই বলবে, ‘আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও ক্রীড়া-কৌতুক করছিলাম।' বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে বিদ্রূপ করছ। 


🔰* তোমরা অজুহাত দেখিও না। তোমরা ঈমানের পর কুফরী করেছ। তোমাদের মধ্যে কোনো দলকে ক্ষমা করলেও অন্যদলকে শাস্তি দেব, কারণ তারা অপরাধী।-আত তাওবা ৯ : ৬৪-৬৬


অর্থাৎ অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করে এই অজুহাত দাঁড় করানো যে, আমরা এমনি একটু ঠাট্টা করছিলাম কিংবা আমরা তো শুধু একসাথে বসে ছিলাম, মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় ।


এই আয়াত থেকে আরো জানা গেল, মুনাফিক যদিও ঈমানহীন, কিন্তু ভাষায় বা ভাবে যেহেতু ঈমানের দাবিদার তাই তার কুফরী কথাবার্তা বা কুফরী আচরণ ‘কুফর বা'দাল ঈমান' (ঈমানের পরে কুফর) তথা ইরতিদাদ হিসেবে গণ্য। তার বিধান হবে মুরতাদের বিধান ।


আর এই যে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের কাউকে কাউকে আল্লাহ তাআলা মাফ করেন, এর অর্থ, দুনিয়ার শাস্তি স্থগিত করা যে, দেখা যাক কুফর ও ইসলামবিদ্বেষে কতদূর সে যেতে পারে। আখিরাতের শাস্তি থেকে এদের কারোরই মুক্তির কোনো উপায় নেই ।


وَعَدَ اللهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ


মুনাফিক নর, মুনাফিক নারী ও কাফেরদেরকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাহান্নামের অগ্নির, যেখানে তারা স্থায়ী হবে, এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহ তাদেরকে লা'নত করেছেন আর তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।-আত তাওবা ৯ : ৬৮


إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا


বরং মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনো কোনো সহায় পাবে না। আন নিসা ৪ : ১৪৫


অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ কেন, এর চেয়েও অনেক কম কষ্টদায়ক বিষয়ও কঠিন আযাবের কারণ । আর সেটাও বৈশিষ্ট্য মুনাফিকদেরই।


وَمِنْهُمُ الَّذِينَ يُؤْذُونَ النَّبِيَّ وَيَقُولُونَ هُوَ أُذُنٌ قُلْ أَذُنَ خَيْرٍ لَكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَيُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِينَ وَرَحْمَةٌ لِلَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ رَسُولَ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ لِيُرْضُوكُمْ وَاللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَقُّ أَنْ يُرْضُوهُ إِنْ كَانُوا مُؤْمِنِينَ . أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّهُ مَنْ يُحَادِدِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَأَنْ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدًا فِيهَا ذَلِكَ الْخِزْيُ الْعَظِيمُ


এবং তাদের মধ্যে এমনও লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে, ‘সে তো কান-পাতলা। বল, তার কান তোমাদের জন্য যা মঙ্গল তা- ই শোনে। তিনি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন এবং মুমিনদেরকে বিশ্বাস করেন; তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন তিনি তাদের জন্য রহমত এবং যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য আছে মর্মন্তুদ শাস্তি I 


🔰* তারা তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তোমাদের নিকট আল্লাহর শপথ করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এরই অধিক হকদার যে, ওরা তাদেরকেই সন্তুষ্ট করে যদি ওরা মুমিন হয় । 


🔰* ওরা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তার জন্য তো আছে জাহান্নামের অগ্নি, যে স্থানে সে স্থায়ী হবে। সেটাই চরম লাঞ্ছনা।-আত তাওবা ৯ : ৬১-৬৩


মুনাফিকদের কাছে আল্লাহর দ্বীন, আল্লাহর ইবাদত ও আল্লাহর আহকাম অতি অপছন্দনীয়

الْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَنِفَافًا وَأَحْدَرُ أَلَّا يَعْلَمُوا حُدُودَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ، وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ مَعْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ، وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُرُبَاتٍ عِنْدَ اللهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُولِ أَلَا إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ إِنْ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ


কুফরী ও কপটতায় মরুবাসীগণ কঠোরতর; এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তার সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার যোগ্যতা এদের অধিক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় । 


🔰* মরুবাসীদের কেউ কেউ, যা তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তা অর্থদণ্ড বলে গণ্য করে এবং তোমাদের ভাগ্যবিপর্যয়ের প্রতীক্ষা করে। মন্দ ভাগ্যচক্র ওদের হোক । আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। মরুবাসীদের কেউ কেউ আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রাসূলের দুআ লাভের উপায় মনে করে। বাস্তবিকই ওটা তাদের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়; আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতে দাখিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-আত তাওবা ৯ : ৯৭-৯৯


নামাযও তাদের কাছে অপছন্দনীয়। এরপরও মুনাফিকী গোপন রাখার জন্য কখনো কখনো লোকদেখানো নামায পড়ে।


مُذَبْذَبِينَ بَيْنَ ذَلِكَ لَا إِلَى هَؤُلَاءِ وَلَا إِلَى هَؤُلَاءِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا


দোটানায় দোদুল্যমান, না এদের দিকে, না ওদের দিকে এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তার জন্য কখনো কোনো পথ পাবে না।-আন নিসা ৪ : ১৪৩


আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব এবং তাঁর প্রদত্ত শরীয়ত অপছন্দ করা কুফরী। যে এই কুফরীতে লিপ্ত ব্যক্তিদের কিছুমাত্র সমর্থন করবে সে মুরতাদ


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرُكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ . وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ


হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান দৃঢ় করবেন। 


🔰* যারা কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন।-মুহাম্মাদ ৪৭ : ৭-৮

আরো ইরশাদ হয়েছে-


إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ . ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ . فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ ذلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ


যারা নিজেদের নিকট সৎপথ ব্যক্ত হওয়ার পর তা পরিত্যাগ করে শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেখায়। 


🔰* এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন, তা যারা অপছন্দ করে। তাদেরকে ওরা বলে, 'আমরা কোনো কোনো বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব”। 

আল্লাহ ওদের গোপন অভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত আছেন । 


🔰* ফিরিশতারা যখন ওদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন ওদের দশা কেমন হবে! 


🔰* এটা এজন্য যে, ওরা তার অনুসরণ করে, যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তাঁর সন্তুষ্টি অপ্রিয় গণ্য করে। তাই তিনি এদের কর্ম নিষ্ফল করে দেন।-সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ : ২৫-২৮


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এটুকু বেয়াদবীও আল্লাহ তাআলা বরদাশত করেন না যে, কথা বলার সময় কেউ তাঁর স্বরের চেয়ে স্বর উঁচু করবে। ইরশাদ হয়েছে যে, শুধু এই অশিষ্ট আচরণের কারণে সকল আমল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ।


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ . يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضِ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ • إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عظيم


হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সমক্ষে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। 


🔰* হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর নিজেদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না। এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল তাঁর সাথে সেই রূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না, কারণ এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে তোমাদের অজ্ঞাতসারে । 


🔰* যারা আল্লাহর রাসূলের সম্মুখে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার। আলহুজুরাত ৪৯ : ১-৩


মোটকথা, ইসলাম, ইসলামের নবী ও ইসলামের নিদর্শন ও ইসলামের বিধানসমূহের প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা ঈমানের অপরিহার্য অংশ, যা ছাড়া ঈমান কল্পনাও করা যায় না। আর এইসব বিষয়কে অবজ্ঞা, বিদ্রূপ করা, বিদ্বেষ পোষণ করা, এমনকি অপ্রীতিকর মনে করাও কুফরী ও মুনাফিকী। এই মানসিকতা পোষণকারীদের ঈমান-ইসলামের সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই ।


৯. ঈমান একটি একক, এতে বিভাজনের অবকাশ নেই

এটি ঈমান সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা পুরোপুরি স্পষ্ট ও স্বীকৃত হওয়ার পরও অনেককে উদাসীনতা প্রদর্শন করতে দেখা যায় ।


ঈমান সাব্যস্ত হওয়ার জন্য ইসলামের সকল অকাট্য বিধান ও বিশ্বাসকে সত্য মনে করা এবং কবুল করা অপরিহার্য। এর কোনো একটিকে অস্বীকার করা বা কোনো একটির উপর আপত্তি তোলাও ঈমান বরবাদ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমন অযু হওয়ার জন্য অযুর সবগুলো ফরয পালন করা জরুরি, কিন্তু তা ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য অযুভঙ্গের সবগুলো কারণ উপস্থিত হওয়া জরুরি নয়। যে কোনো একটি কারণ দ্বারাই অযু ভেঙ্গে যায়। তদ্রূপ ঈমান তখনই অস্তিত্ব লাভ করে যখন ইসলামের সকল অকাট্য বিধান ও বিশ্বাস মন থেকে কবুল করা হয়। পক্ষান্তরে এসবের কোনো একটিকেও অস্বীকার করার দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায় ৷


আর অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ তো এতই ভয়াবহ যে, তা শরয়ী দলীলে প্ৰমাণিত ছোট কোনো বিষয়ে প্রকাশিত হলেও সাথে সাথে ঐ ব্যক্তির ঈমান শেষ হয়ে যাবে এবং তার উপর কুফরের বিধান আরোপিত হবে ।


আকাইদ ও আহকামের বিদ্রূপ কিংবা অস্বীকার তো এজন্যই কুফর যে, তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য বর্জন এবং তাঁদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ। সুতরাং গোটা ইসলামকে অস্বীকার বা বিদ্রূপ করা আর ইসলামের কোনো একটি বিষয়কে অস্বীকার বা বিদ্রূপ করা একই কথা! উভয় ক্ষেত্রে একথা বাস্তব যে, ঐ ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং ঔদ্ধত্য ও বিরুদ্ধতা প্রকাশ করেছে। ইবলীস তো কাফির মরদূদ হয়েছিল একটি হুকুমের উপর আপত্তি করেই। বিষয়টি এমনিতেও স্পষ্ট। এরপরও আল্লাহ তাআলা কুরআন হাকীমে একাধিক জায়গায় তা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন-


فيأَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدَّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ


তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর? সুতরাং তোমাদের যারা এরকম করে, তাদের একমাত্র পরিণাম পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কেয়ামতের দিন তারা কাঠিন শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন।-আল বাকারা ২ : ৮৫

আরো ইরশাদ হয়েছে-


إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا • أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا ، وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَمْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ أُولَئِكَ سَوْفَ يُؤْتِيهِمْ أُجُورَهُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا


যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে, আমরা কতক (রাসূল)- এর প্রতি তো ঈমান রাখি এবং কতককে অস্বীকার করি। আর (এভাবে তারা (কুফর ও ঈমানের মাঝে) মাঝামাঝি একটি পথ গ্রহণ করতে চায় । এরূপ লোকই সত্যিকারের কাফির। আর আমি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি ।


যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাদের কারও মধ্যে কোনোও পার্থক্য করবে না, আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মফল দান করবেন। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা নিসা ৪ : ১৫০-১৫২


যারা শরীয়তের শুধু শান্তির বিধান গ্রহণ করেন আর জিহাদের বিধানকে সন্ত্রাস বা উগ্রবাদিতা বলেন; উপদেশের কথাগুলো গ্রহণ করেন আর হদ- তাযীর ও কিসাসের বিধান বর্জনীয় মনে করেন; ইবাদতের বিষয়গুলো গ্রহণ করেন।

আর লেনদেন ও হালাল-হারামের বিধান মানতে অসম্মত থাকেন; ব্যক্তিগত জীবনের বিধিবিধান গ্রহণ করেন, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র-পরিচালনার বিধি-বিধান (প্রশাসন, নির্বাহী ও বিচার-বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট) সম্পর্কে বিরূপ থাকেন; অথবা ইবাদত ও লেনদেনের বিধান মানেন, কিন্তু বেশ ভূষা, আনন্দ-বিষাদ, পর্ব-উৎসব ও জীবন যাপনের আদব কায়েদার ইসলামী নির্দেশ ও নির্দেশনার প্রতি বিরূপ থাকেন বা মানাকে জরুরি মনে করেন না এরা সবাই ইসলামের কিছু অংশের অস্বীকার বা কিছু অংশের উপর বিরুদ্ধপ্রশ্নের কারণে নিজের ঈমান হারিয়ে বসেছেন।

তাদের ঈমান মূলত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর নয়; নিজ পছন্দ-অপছন্দের উপর কিংবা নেতা ও গুরুর পছন্দ-অপছন্দের উপর। নতুবা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান তো এইটাও এবং ঐটাও। এরপরও এই দ্বিমুখিতা কেন ? আল্লাহর আদেশ তো এই-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السّلْمِ كَافَةٌ وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عدو مبين


হে মুমিনগণ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ।-আল বাকারা ২ : ২০৮


ভালোভাবে বুঝে নিন, শরীয়তের বিধি বিধানকে হক ও অবশ্যপালনীয় বলে স্বীকার করার পর পালনে ত্রুটি হলে তা গুনাহ, কুফর নয় । কারণ এই ব্যক্তি নিজেকে অপরাধী মনে করে। পক্ষান্তরে বিধানের উপর বিরুদ্ধপ্রশ্ন বা প্রতিবাদের অর্থ সরাসরি আনুগত্য ত্যাগ, যা সাধারণ অপরাধ নয়, বিদ্ৰোহ । এটা মানুষকে দুনিয়ার বিধানে 'মুবাহুদ দম' (হত্যাযোগ্য) আর আখিরাতের বিধানে চিরজাহান্নামী সাব্যস্ত করে।


১০. ঈমানী আকাইদ ও আহকাম স্পষ্টভাবে ঘোষিত ও গোটা উম্মাহর দ্বারা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত, এতে বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা অস্বীকারেরই এক প্রকার


ঈমানী আকাইদ ও আহকাম অস্বীকার করা, অবজ্ঞা ও বিদ্রূপ করা এবং বিরুদ্ধ প্রশ্নের লক্ষ্যবস্তু বানানো যেমন কুফর তেমনি এগুলোর কোনো একটিরও এমন কোনো ‘ব্যাখ্যা’করাও সরাসরি কুফর, যার দ্বারা তার প্রতিষ্ঠিত অর্থই বদলে যায়। কোনো কিছুর অপব্যাখ্যা ও অর্থের বিকৃতি হচ্ছে ঐ বিষয়টি অস্বীকারের ভয়াবহতম প্রকার। ঈমানের বিষয়গুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থেই ঈমান আনতে হবে। নিজের পক্ষ হতে সেগুলোর কোনো অর্থ নির্ধারণ করে, কিংবা কোনো বেদ্বীনের নবউদ্ভাবিত অর্থ গ্রহণ করে ঈমানের দাবি করা সম্পূর্ণ অর্থহীন ও সুস্পষ্ট মুনাফেকী ।


‘ব্যাখ্যা' তো ঐখানে হয় যেখানে ভাষার বাকরীতি ও মর্মোদ্ধারের নীতিমালা অনুযায়ী একাধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু যেখানে কোনো বিধান বা বিশ্বাসের অর্থ ও মর্ম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে অসংখ্য মুমিনের সুসংহত সূত্রে প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসে এবং যাতে প্রতি যুগে মুসলিম উম্মাহর ইজমা ও ঐকমত্য বিদ্যমান থাকে সেখানে ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে কীভাবে? সেখানে তো ঐ অর্থই নিশ্চিত ও নির্ধারিত। ওখানে ভিন্ন ‘ব্যাখ্যার’ অর্থ ঐ অকাট্য ও প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে অস্বীকার করা ।


যেমন কেউ বলল, 'নামায সত্য, কিন্তু তা পাঁচ ওয়াক্ত নয়, দুই ওয়াক্ত।' কিংবা বলল, 'নামায সত্য, কিন্তু আসল নামায তা নয়, যা মুসল্লিগণ মসজিদে আদায় করেন, আসল নামায তো মনের নামায । যে তা আদায় করতে পারে তার দেহের নামাযের প্রয়োজন নেই।' (নাউযুবিল্লাহ)


কিংবা বলল, ‘শরীয়ত সত্য, কিন্তু তা আম বা সাধারণ মানুষের জন্য, খাস বা বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য আছে আলাদা শরীয়ত।' (নাউযুবিল্লাহ) কিংবা বলল, ‘শরীয়ত তো প্রাচীন যুগের ব্যাপার, আজকের উন্নতির যুগে এর সংস্কার প্রয়োজন।' (নাউযুবিল্লাহ)


কিংবা বলল, “শরীয়ত মানা একটি ঐচ্ছিক ব্যাপার। মানলে ভালো, না মানলেও দোষ নেই ।' (নাউযুবিল্লাহ)


কিংবা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের মতো বলল, 'মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ও খাতামুন্নাবিয়্যীন। তবে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও নবী, তিনি জিল্লী বা বুরুজী নবী। এর দ্বারা খতমে নবুওতের আকীদায় কোনো ধাক্কা লাগে না।' (নাউযুবিল্লাহ)


তো এইসব কুফরী ‘ব্যাখ্যা' এবং এ জাতীয় আরো অসংখ্য 'ব্যাখ্যা', যার আবরণে বেদ্বীন-মুলহিদ চক্র ‘জরুরিয়াতে দ্বীন' (দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিষয়) ও ‘কাওয়াতিউল ইসলাম' (ইসলামের অকাট্য বিষয়াদি)-এর অস্বীকার করে এবং সেই কুফরীকে ঢেকে রাখার অপচেষ্টা করে, এর দ্বারা তো তাদের কুফরী আরো ভয়াবহ হয়ে যায়। ‘অস্বীকারে’র সাথে ‘অপব্যাখ্যা’ যুক্ত করে নিজেদেরকে সাধারণ কাফিরের চেয়েও মারাত্মক প্রকারের কাফির- মুলহিদ, যিন্দীক ও মুনাফিকের সারিতে অন্তর্ভুক্ত করে।


আল্লাহ তাআলার এই হুঁশিয়ারি এদের সকলের মনে রাখা উচিৎ-

إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آيَاتِنَا لَا يَحْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ خَيْرٌ أَمْ مَنْ يَأْتِي آمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اعْمَلُوا مَا شِتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ


যারা আমার আয়াতসমূহকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচরে নয় । শ্রেষ্ঠ কে-যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে, না যে কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে সে? তোমাদের যা ইচ্ছা কর; তোমরা যা কর তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা।-হা-মীম আসসাজদা ৪১ : ৪০


দ্বীনকে অপব্যাখ্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহ তাআলা ‘সাবীহুল মুমিনীন'কে মানদণ্ড বানিয়েছেন। এবং ‘সাবীলুল মুমিনীন' (মুমিনের সর্বসম্মত পথ) থেকে বিচ্যুতিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধতার মতো জাহান্নামে যাওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন । এ কারণে কোনো ইসলামী আকীদা বা হুকুমের (বিশ্বাস বা বিধানের) এমন সকল ‘ব্যাখ্যা’র গন্তব্য জাহান্নাম, যা উম্মাহর সর্বসম্মত ‘ব্যাখ্যার' বিরোধী ।


وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا


🔰* কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যে দিকেই সে ফিরে যায়, সে দিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব, আর তা কত মন্দ আবাস!-আন নিসা ৪ : ১১৫


আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে একথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মুনাফিকদের কাছে আল্লাহ তাআলার এই মানদণ্ড পছন্দনীয় নয়। তারা ঈমানের দাবি করে, কিন্তু মুমিনদের মতো ঈমান আনে না, নিজেদের মনমতো ঈমান আনে। এরা মুমিনদের মনে করে বুদ্ধিহীন।

আজও আমরা একই প্রবণতা লক্ষ করছি-

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ أَمِنُوا كَمَا أَمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا أَمَنَ السُّفَهَاءُ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَكِنْ لَا يَعْلَمُونَ . وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِئُونَ . اللَّهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمُدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ . أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَى فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ


যখন তাদেরকে বলা হয়, যে সকল লোক ঈমান এনেছে তোমরাও তাদের মত ঈমান আনয়ন কর, তারা বলে, নির্বোধগণ যেরূপ ঈমান এনেছে আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব? জেনে রাখ, এরাই নির্বোধ, কিন্তু তারা জানে না। 


🔰* যখন তারা মুমিনগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আর যখন নিভৃতে তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি। আমরা শুধু তাদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি। 


🔰* আল্লাহ তাদের সাথে তামাশা করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন। 


🔰* এরাই হেদায়াতের বিনিময়ে ভ্রান্তি ক্রয় করে। সুতরাং তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি, তারা সৎপথেও পরিচালিত নয় ।-সূরা আল বাকারা২ : ১৩-১৬

সুতরাং হেদায়াত এদের কাছে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে তাদেরই কাছে যাদেরকে এরা ‘বুদ্ধিহীন' বলে ।


১১। দিল ও যবানের একাত্মতা ঈমান। এতে নেফাকের কোনো স্থান নেই


إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ  اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ


যখন মুনাফিকরা তোমার কাছে আসে তারা বলে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল' । আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।


🔰* ওরা ওদের শপথগুলিকে ঢালরূপে ব্যবহার করে এবং ওরা আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে। ওরা যা করছে তা কত মন্দ!-আল মুনাফিকূন ৬৩ : ১-২

সামনে ইরশাদ হয়েছে-


هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ حَتَّى يَنْفَضُّوا وَلِلَّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ . يَقُولُونَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُحْرِ جَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَ وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ


ওরাই বলে, ‘তোমরা আল্লাহর রাসূলের সহচরদের জন্য ব্যয় করো না, যাতে ওরা সরে পড়ে'। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ধন-ভাণ্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা তা বুঝে না । ওরা বলে, আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে যারা মর্যাদাবান তারা হীনদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু মর্যাদা তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল ও মুমিনদের। তবে মুনাফিকরা তা জানে না।-আল মুনাফিকূন ৬৩ : ৭-৮


১২. ঈমান একটি স্থায়ী অঙ্গিকার, ইরতিদাদ' সাধারণ কুফরের চেয়েও ভয়াবহ কুফর


ঈমান আল্লাহ ও বান্দাদের মধ্যকার এক স্থায়ী অঙ্গিকারের নাম; যার কোনো মেয়াদ নেই। যখনই ঈমানের সম্পদ পাওয়া গেল তখন থেকেই এর পুষ্টি ও বর্ধন, শক্তি ও সংস্কারে মগ্ন থাকা জরুরি। সবসময় সতর্ক থাকা চাই, এমন কোনো কথা বা কাজ যেন প্রকাশিত না হয়, যা ঈমান নষ্ট করে । আর আল্লাহর দরবারে তাঁর শেখানো দুআ করতে থাকা চাই—


رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ


হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্ত রকে সত্যলংঘনপ্রবণ করো না এবং তোমার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দাও, নিশ্চয়ই তুমি মহাদাতা ।-আলে ইমরান ৩ : ৮


আল্লাহর কাছে ঐ বান্দার ঈমানই গ্রহণযোগ্য, যে ঈমানের উপর অবিচল থাকে। পক্ষান্তরে যে ঈমান থেকে সরে যায় সে তো দুই বিদ্রোহে লিপ্ত-কুফরের বিদ্রোহ ও ইরতিদাদের বিদ্রোহ ।


অবিচল মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে খোশখবরি-

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ . أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ


🔰* যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক তো আল্লাহ' অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না ।

🔰* তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে, তারা যা করত তার পুরস্কার স্বরূপ।-আল আহকাফ ৪৬ : ১৩-১৪

অন্য আয়াতে আছে-


إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنتُمْ تُوعَدُونَ . نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ ، نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ


যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ', অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের নিকট অবতীর্ণ হয়, ফিরিশতা এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও। 


🔰* ‘আমরাই তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা ফরমায়েশ কর। 


🔰* এটা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে আপ্যায়ন। 

- হামীম আসসাজদা ৪১ : ৩০-৩২


পক্ষান্তরে যারা ঈমানের উপর কায়েম থাকে না; বরং পশ্চাদপসরণ করে কিংবা বারবার এদিক-ওদিক আসা-যাওয়া করে এদের কাছে দ্বীন এক ক্রীড়ার বস্তু! ইরতিদাদ (সত্য ধর্ম থেকে পিছু হটা) মূলত মুনাফিকদের কাজ। এর দ্বারা তারা দুর্বল ঈমানদারদের সংশয়গ্রস্ত করতে চায়। কুরআন মাজীদে তাদের এই অপকৌশলের বিবরণ আছে। (দেখুন : আলে ইমরান ৩ : ৭২-৭৩)


যে কোনো ইরতিদাদ সাধারণ কুফর থেকে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর তো সত্য দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা বা গ্রহণ না করা, কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতাই নয়, এ হচ্ছে বিরুদ্ধতা। সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ । বরং ইরতিদাদ তো সত্য দ্বীনের প্রতি বিরুদ্ধতার পাশাপাশি ‘ইফসাদ ফিল আরদ' (ভূপৃষ্ঠে দুষ্কৃতি)ও বটে। বিশেষত মুরতাদ (সত্য দ্বীন ত্যাগকারী) যখন কটাক্ষ-কটূক্তি এবং অবজ্ঞা বিদ্রূপে লিপ্ত হয়। এ তো সরাসরি ‘মুহারিব' (যুদ্ধঘোষণাকারী) ও ‘মুফসিদ ফিল আরদ' (ভূপৃষ্ঠে দুষ্কৃতিকারী)।

মুরতাদ সম্পর্কে কুরআন কারীমের আসমানী হুঁশিয়ারি পাঠ করুন-


إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ أَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا • بَشِّرِ الْمُنَافِقِينَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا • الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاء مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنْ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا


যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে, অতঃপর তাদের কুফরীর প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোনো পথে পরিচালিত করবেন না ।

🔰* মুনাফিকদেরকে শুভসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে!

🔰* মুমিনগণের পরিবর্তে যারা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি ওদের নিকট ইযযত চায়? সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই।-আন নিসা ৪ : ১৩৭-১৩৯


كَيْفَ يَهْدِي اللهُ قَوْمًا كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ وَشَهِدُوا أَنَّ الرَّسُولَ حَقٌّ وَجَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ . أُولَئِكَ جَزَاؤُهُمْ أَنَّ عَلَيْهِمْ لَعْنَةَ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ . خَالِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفِّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْظُرُونَ • إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَأَصْلَحُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ


আল্লাহ কিরূপে সৎপথে পরিচালিত করবেন সেই সম্প্রদায়কে, যারা ঈমান আনার পর ও রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেওয়ার পর এবং তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর কুফরী করে? আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না, 


🔰* এরাই তারা যাদের কর্মফল এই যে, তাদের উপর আল্লাহর, ফিরিশতাগণের এবং মানুষসকলের লানত, 


🔰* তারা তাতে স্থায়ী হবে। তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেওয়া হবে না; 


🔰* তবে এর পর যারা তওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় তারা ব্যতিরেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৮৯


কিন্তু যারা সারা জীবন কুফরের উপর থাকে আর মৃত্যু উপস্থিত হলে তওবা করে তাদের তওবা কবুল হয় না ।


إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُونَ


ঈমান আনার পর যারা কুফরী করে এবং যাদের সত্য প্রত্যাখ্যান-প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না । এরাই পথভ্রষ্ট।—আলে ইমরান ৩ : ৯০

আরো ইরশাদ হয়েছে-


وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا


তওবা কবুলের বিষয়টি তাদের জন্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে । পরিশেষে তাদের কারও যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন বলে, এখন আমি তওবা করলাম এবং তাদের জন্যও নয়, যারা কুফর অবস্থায়ই মারা যায় । এরূপ লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।-সূরা নিসা (৪) : ১৮


আর এই প্রশ্ন যে, দুনিয়াতে মুরতাদের শাস্তি কী, এর জবাব তো সুস্পষ্টই। মুরতাদ যেহেতু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ ঘোষণাকারী ও ভূপৃষ্ঠে অনাচার বিস্তারকারী এজন্য তার শাস্তি মৃতুদণ্ড, যা কার্যকর করা সরকারের উপর ফরয।


إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ * إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ


যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। তবে, তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার পূর্বে যারা তওবা করবে তাদের জন্য নয়। সুতরাং জেনে রাখ যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা আল মাইদা৫ : ৩৩-৩৪

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—


من بدل دينه فاقتلوه


অর্থাৎ, যে তার ধর্ম (ইসলাম) পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর ।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২২


অন্য হাদীসে আছে, একবার মুআয রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর সাথে সাক্ষাত করতে এলেন, (তাঁরা উভয়ে ঐ সময় ইয়ামানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন) মুআয রা. দেখলেন, এক লোককে তার কাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? আবু মূসা আশআরী রা. বললেন, এ লোক ইহুদী ছিল, ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আবার ইহুদী হয়ে গেছে। আপনি বসুন। মুআয রা. বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত তওবা কবুলের বিষয়টি তাদের জন্য নয়, যারা অসৎকর্ম করতে থাকে । 


পরিশেষে তাদের কারও যখন মৃত্যুক্ষণ এসে পড়ে, তখন বলে, এখন আমি তওবা করলাম এবং তাদের জন্যও নয়, যারা কুফর অবস্থায়ই মারা যায় ।

এরূপ লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।-সূরা নিসা (৪) : ১৮


আর এই প্রশ্ন যে, দুনিয়াতে মুরতাদের শাস্তি কী, এর জবাব তো সুস্পষ্টই। মুরতাদ যেহেতু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ ঘোষণাকারী ও ভূপৃষ্ঠে অনাচার বিস্তারকারী এজন্য তার শাস্তি মৃতুদণ্ড, যা কার্যকর করা সরকারের উপর ফরয।


إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ * إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ


যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। তবে, তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার পূর্বে যারা তওবা করবে তাদের জন্য নয়।

সুতরাং জেনে রাখ যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা আল মাইদা ৫ : ৩৩-৩৪

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—


من بدل دينه فاقتلوه


অর্থাৎ, যে তার ধর্ম (ইসলাম) পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর ।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২২


অন্য হাদীসে আছে, একবার মুআয রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর সাথে সাক্ষাত করতে এলেন, (তাঁরা উভয়ে ঐ সময় ইয়ামানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন) মুআয রা. দেখলেন, এক লোককে তার কাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? আবু মূসা আশআরী রা. বললেন, এ লোক ইহুদী ছিল, ইসলাম গ্রহণ করেছিল, আবার ইহুদী হয়ে গেছে।

আপনি বসুন। মুআয রা. বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালা ।

তিনি একথা তিনবার বললেন। সেমতে ঐ মুরতাদকে হত্যা করা হল।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৭৩৩


বিশেষত যে নাস্তিক বা মুরতাদ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে কটূক্তি করে কিংবা ইসলামের নিদর্শনের অবমাননা করে সে তো সরাসরি ‘মুফসিদ ফিল আরদ” (ভূপৃষ্ঠে দুষ্কৃতিকারী)। এ ব্যক্তি রাসূল অবমাননাকারী হিসেবেও “ওয়াজিবুল কতল” (অপরিহার্যভাবে হত্যাযোগ্য) এবং দুষ্কৃতিকারী হিসেবেও।


একারণে প্রত্যেক মুসলিম জনপদের দায়িত্বশীলদের উপর ফরয, উপরোক্ত দণ্ড কার্যকর করে নিজেদের ঈমানের পরিচয় দেওয়া। যেখানে এ আইন নেই তাদের কর্তব্য, অবিলম্বে এই আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর করা, যদি তারা আখিরাতের কল্যাণ চান ।


তারা যদি এই সৎসাহস করেন তবে তা তাদের ‘মসনদে'র জন্যও উত্তম। নতুবা মনে রাখতে হবে, যাদের নারাজির ভয়ে তারা এইসব দণ্ড কার্যকর করা থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করছেন তারা না তাদের মসনদ রক্ষা করতে পারবেন, না আখিরাতের কঠিন পাকড়াও থেকে মুক্ত করতে পারবেন, আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া তো অনিবার্য-ই ।


১৩। ঈমানের সবচেয়ে বড় রোকন তাওহীদ, শিরক মিশ্রিত ঈমান আল্লাহর কাছে ঈমানই নয়


ঈমানের সর্বপ্রথম রোকন হচ্ছে “ঈমান বিল্লাহ' (আল্লাহর উপর ঈমান)। আর ঈমান বিল্লাহর প্রথম কথা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করা, একমাত্র তাঁকেই 'রব' ও সত্য মাবুদ বলে মানা, রুবুবিয়্যত ও উলূহিয়্যতের বিষয়ে তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা।

একমাত্র আলিমুল গাইব, হাজির-নাজির, মুখতারে কুল (সব বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী), মুশকিল কুশা (সংকট মোচনকারী) বিপদাপদে তাঁকেই ত্রাণকারী মনে করবে। 


তাঁর বিশেষ হক ও একান্ত বৈশিষ্ট্যসমূহে কাউকে শরীক করবে না। সাধারণ কার্যকারণ ও উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে না। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, জীবন-মৃত্যু, উপকার-অপকার, সুস্থতা ও নিরাপত্তা একমাত্র তাঁরই হাতে । তিনিই তা দান করেন। রিযিকদাতা একমাত্র তিনি। গোটা জগতের এক, অদ্বিতীয় স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রকও তিনিই।

শরীয়ত দান ও হালাল-হারাম নির্ধারণ তাঁরই অধিকার। এতে কাউকে শরীক করবে না-না কোনো ইজম বা মতবাদকে, না কোনো নেতা বা দলকে, না রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়কে।

মোটকথা, তাওহীদকে পূর্ণরূপে ধারণ করা ও শিরক থেকে পুরাপুরি বেঁচে থাকা ঈমানের সবচেয়ে বড় রোকন। 

আল্লাহ তাআলার কাছে মুশরিকের ঈমান ঈমানই নয় । মুশরিককে তিনি কখনো মাফ করেন না ।


মুশরিকের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার অভিযোগ তো এটাই যে, সে ঈমানের সাথে শিরক মিশ্রিত করে।


وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ . أَفَأَمِنُوا أَنْ تَأْتِيَهُمْ غَاشِيَةٌ مِنْ عَذَابِ اللهِ أَوْ تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ . قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ


🔰* তাদের অধিকাংশ আল্লাহ্য় বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।


🔰* তবে কি তারা আল্লাহর সর্বগ্রাসী শাস্তি থেকে অথবা তাদের অজ্ঞাতসারে কিয়ামতের আকস্মিক উপস্থিতি থেকে নিরাপদ? 


🔰* বল, —এটাই আমার পথ : আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহ্বান করি সজ্ঞানে-আমি এবং আমার অনুসারীগণও। আল্লাহ্ মহিমান্বিত এবং যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই।'—ইউসুফ (১২) : ১০৬-১০৮

 

আল্লাহ তাআলার দাবি সবসময় এটাই যে, ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান যেন’ খাঁটি তাওহীদের সাথে হয় এবং সব ধরনের শিরকের মিশ্রণ থেকে পাক সাফ হয়।

কিছু আয়াত দেখুন :

قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ . وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ

🔰* বল, ‘আমি তো আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ‘ইবাদত করার; 


🔰* আর আদিষ্ট হয়েছি, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রণী হই।’--

আযযুমার (৩৯) : ১১-১২


أَمِ اتَّخَذُوا آلِهَةً مِنَ الْأَرْضِ هُمْ يُنْشِرُونَ . لَوْ كَانَ فِيهِمَا أَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَنَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ . لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ . أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آلِهَةٌ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ هَذَا ذِكْرُ مَنْ مَعِيَ وَذِكْرُ مَنْ قَبْلِي بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ الْحَقَّ فَهُمْ مُعْرِضُونَ . وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ

إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ


🔰* তারা মৃত্তিকা থেকে তৈরি যেসব দেবতা গ্রহণ করেছে সেগুলো কি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম?

🔰* যদি আল্লাহ ব্যতীত বহু ইলাহ থাকত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে তা থেকে ‘আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র, মহান। 


🔰* তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে। 


🔰* তারা কি তাঁকে ছাড়া বহু ইলাহ গ্রহণ করেছে? বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর। এটাই, আমার সাথে যারা আছে তাদের জন্য উপদেশ এবং এটাই উপদেশ ছিল আমার পূর্ববর্তীদের জন্য।' কিন্তু তাদের অধিকাংশই প্রকৃত সত্য জানে না, ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । 


🔰* আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ছাড়া যে, ‘আমি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ্ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর।'-আল আম্বিয়া (২১) : ২১-২৫


وَمَا تَفَرَّقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَةُ ، وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ . الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أُولَئِكَ هُمْ شَرٌّ البرية


🔰* যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা তো বিভক্ত হল তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর। 


🔰* তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর 'ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত দিতে, এ-ই সঠিক দ্বীন। 


🔰* কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফরী করে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে; তারাই সৃষ্টির অধম ।-আলবায়্যিনাহ (৯৮) : ৪-৬


اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهَا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ • يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ وَ هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ


🔰* তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের পণ্ডিতগণকে ও সংসার-বিরাগীগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম-তনয় মসীহকেও । কিন্তু তারা এক ইলাহের ‘ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই । তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র! 


🔰* তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কাফিরগণ অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ছাড়া অন্য কিছু চান না। 


🔰* মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অন্য সকল দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূল পাঠিয়েছেন।-আত তাওবা (৯) : ৩১-৩৩


আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা হারাম। এর দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষ কাফির ও মুশরিক হয়ে যায়। তা সে পাথর বা মূর্তিকে শরীক করুক কিংবা জিন ও শয়তানকে করুক; অথবা ফেরেশতাদেরকে করুক, কিংবা কোনো নবী ও রাসূলকে শরীক করুক, যাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন তাওহীদ গ্রহণ ও শিরক বর্জনের পয়গাম দিয়ে। কিংবা এমন কোনো আলিম ও বুযুর্গকে শরীক করুক, যিনি জীবনভর মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, কিংবা এমন কোনো নেতা ও গুরুকে শরীক করুক, যে কথা ও কাজের দ্বারা মানুষকে তাওহীদ থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। সর্বাবস্থায় শিরক শিরকই বটে আর এতে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর দুশমন ও বিদ্রোহী কাফির ও মুশরিক।


কুরআন হাকীমে সব প্রকারের শিরক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং সকল শ্রেণীর মুশরিককে জাহান্নামের হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে ।


أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَنْ لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ ، وَأَنِ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ


হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? * আর আমারই ইবাদত কর, এটাই সরল পথ।—ইয়া সীন (৩৬) : ৬০-৬১


قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنتُمْ فِي شَكٍّ مِنْ دِينِي فَلَا أَعْبُدُ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ أَعْبُدُ اللَّهَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ . وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ . وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ . وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ يُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ


বল, হে মানুষ! তোমরা যদি আমার দ্বীনের প্রতি সংশয়যুক্ত হও তবে জেনে রাখ তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত কর আমি তাদের ইবাদত করি না। পরন্তু আমি ইবাদত করি আল্লাহর যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং আমি মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।


(আমাকে আরও আদেশ দেওয়া হয়েছে যে,) তুমি একনিষ্ঠভাবে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ডাকবে না, যা তোমার উপকারও করে না, অপকারও করে না, কারণ তা করলে তখন তুমি অবশ্যই জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এবং আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই এবং আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করবার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি মঙ্গল দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা ইউনুস (১০) ১০৪-১০৭


إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا


🔰* নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। তা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।-আন নিসা (৪) : ৪৮


স্মরণ রাখা উচিত, তাওহীদই হল ঐ বিষয়, যার দাওয়াত নিয়ে সকল নবী রাসূলকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্যই পাঠিয়েছেন। তাঁর উম্মতেরও এটাই দায়িত্ব। রিব’য়ী ইবনে আমের রা.সহ অন্যান্য সাহাবীদের ভাষায়-


ومن ضيق الدنيا إلى الله ابتعثنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام.


অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের প্রেরণ করেছেন আল্লাহর বান্দাদেরকে বান্দার গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে দাখেল করতে। দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে তার প্রশস্ততার দিকে নিয়ে যেতে এবং সকল ধর্মের জুলুম থেকে মুক্ত করে ইসলামের ইনসাফের ছায়াতলে নিয়ে আসতে।


১৪। ঈমানের দাবি, মুয়ালাত ও বারাআত ঈমানের ভিত্তিতেই হবে

যারা ঈমানের নেয়ামত ও ইসলামের আলো থেকে বঞ্চিত তাদের কাছে বর্ণ, বংশ, ভাষা, ভূখণ্ড, সংস্কৃতি, মতবাদ, রাজনৈতিক দল ও দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারিত হয়, আর এই জাতীয়তাই তাদের কাছে মুয়ালাত ও বারাআত (বন্ধুত্ব ও সম্পর্কচ্ছেদ) এবং পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার মানদণ্ড হয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা সরাসরি জাহেলিয়্যাত। ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ণ, বংশ, ভাষা ও ভূখণ্ড নির্বিশেষে সকল মুমিন এক জাতি। আর অন্যান্য অমুসলিম বিভিন্ন জাতি হলেও ইসলামের বিপরীতে তারা অভিন্ন জাতি। “আলকুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদা” (সকল কুফর অভিন্ন মিল্লাত) যেমন শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত তেমনি তা বাস্তবতাও বটে।


ইসলামের শিক্ষায় ‘মুয়ালাত' ও 'বারাআত' (তথা বন্ধুত্ব পোষণ ও বর্জন)-এর মানদণ্ড ঈমান। আর পরস্পর সহযোগিতার মানদণ্ড ভালো কাজ ও খোদাভীরুতা।

আমি যদি মুমিন হই তাহলে আল্লাহর সব মুমিন বান্দার সাথে আমার বন্ধুত্ব ও ভালবাসা। তা সে যে বর্ণের, যে ভাষার, যে বংশের বা যে দেশেরই হোক না কেন।

তার রাজনৈতিক পরিচয়ও যা-ই হোক না কেন। তার সাথে আমার ঈমানী বন্ধুত্ব সর্বাবস্থায় অটুট থাকবে। (উল্লেখ্য, কোনো মুসলমানের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার এবং ঐ দলীয় পরিচিতি বহন করার শরয়ী বিধান কী এবং এতে কী আলোচনা আছে তা এ নিবন্ধের বিষয়বস্তু নয়) মুমিনের সাথে আমার এই বন্ধুত্ব ঈমানের কারণে এবং আল্লাহর জন্য, সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়।

এ কারণে আল্লাহর নাফরমানীর ক্ষেত্রে না তার সঙ্গ দিব, না তার সাহায্য করব। সে যদি কোনো অমুসলিমের উপরও জুলুম করে আমি তার সহযোগিতা করব না; বরং সাধ্যমত তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করব।


আর যে অমুসলিম (দ্বীন ও আখিরাত অস্বীকারকারী কিংবা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসারী যে কোনো কাফির, মুশরিক, মুনাফিক) তার সাথে আমার আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ। কারণ সে আমার, তার ও গোটা জগতের রব আল্লাহর বিদ্রোহী। আর যেহেতু এই শত্রুতা শুধু আল্লাহর জন্য, কোনো সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে নয়, এ কারণে আমি তার সাথে কখনো না-ইনসাফী করব না; বরং যদি দেখি, সে মজলুম হচ্ছে আর তাকে জুলুম থেকে মুক্ত করার সামর্থ্য আমার আছে তাহলে জুলুম থেকে মুক্ত করতেও আমি পিছপা হব না।


দু'জন লোকের মাঝে হয়তো ভাষা, ভূখণ্ড, বর্ণ, গোত্র, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক পরিচয় সব বিষয়ে অভিন্নতা আছে, কিন্তু এদের একজন মুসলিম অন্যজন অমুসলিম, তো এই সকল অভিন্নতার কারণে মুসলিমের উপর অমুসলিমের যে হক্বগুলো সাব্যস্ত হয় তা তো ঐ মুসলিম অবশ্যই আদায় করবেন কিন্তু এদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে না; বরং মুসলিম তাকে আল্লাহর জন্য দুশমনই মনে করবে যে পর্যন্ত না সে ঈমান আনে ও ইসলাম কবুল করে।


قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَاءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ ربَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَننَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ


তোমার জন্য ইবরাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল,

'তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন'।-

সূরা মুমতাহিনা ৬০ : ৪


আল্লাহ তাআলার হুকুম :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ مِنْ أَزْوَاحِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ


🔰*‘হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিগণের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু; অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থেক।- আতাগাবুন (৬৪) : ১৪


এ প্রসঙ্গে কুরআনে হাকীমের শিক্ষা অতি স্পষ্ট। কুরআনে আমাদের মনোযোগের সাথে পাঠ করা উচিত যে, ইবরাহীম আ. তার মুশরিক পিতা আযরের সাথে কী আচরণ করেছিলেন, নূহ আ.-এর কাফির পুত্রের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন। লূত আ.-এর স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেছেন আর এর বিপরীতে ফিরাউনের মুমিন স্ত্রী সম্পর্কে কী বলেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিবকে কী বলেছেন, যিনি তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন, কিন্তু কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে ইসলাম কবুল করেননি। কুরআন কারীম, সীরাতে নববী ও হায়াতুস সাহাবা বিষয়ক গ্রন্থাদিতে এ ধরনের ঘটনা আমাদের বার বার পাঠ করা উচিৎ, যাতে বিষয়টি আমাদের সামনে ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে যায় ।



মোটকথা, ‘মুয়ালাত' (বন্ধুত্ব) ও 'মুয়াদাত' (শত্রুতা)-এর মানদণ্ড দ্বীন ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। ইসলামে ‘মুয়ালাতের’ মানদণ্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম আর ‘মুয়াদাত'-এর ভিত্তি শিরক ও কুফর। যে কেউ মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে শুধু ঈমান ও ইসলামের কারণেই, অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই মুয়ালাতের হকদার এবং সকল বাস্তব মানবিক অধিকার (যার বিধান ইসলাম দিয়েছে, বর্তমান সময়ের অসার, অবাস্তব বা প্রতারণামূলক মৌখিক অধিকার নয়) তার প্রাপ্য।

আর যে শিরক বা অন্য কোনো ধরনের কুফর অবলম্বন করেছে (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই কোনো না কোনো প্রকার) তার সাথে ‘মুয়ালাত' হারাম; বরং তা কুফরের চিহ্ন।


অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ‘মুয়ালাত' ও 'বারাআতে’র এই নীতিতে অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য, স্বয়ং পিতামাতাও ব্যতিক্রম নন ৷


আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-


وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ . وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَتَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ تُطِعْهُمَا وَصَاحِبُهُمَا في فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ


🔰* আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বৎসরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট। 


🔰* তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদভাবে এবং যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর, অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই কাছে এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবহিত করব।-লুকমান (৩১) ১৪-১৫

আরো ইরশাদ-


مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ  وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ : وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأُ مِنْهُ إِنْ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهُ حَلِيمٌ


🔰* আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মু'মিনদের জন্য সংগত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিশ্চিতই এরা জাহান্নামী। * ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাঁকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন তাঁর কাছে এটা সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল।-আত তাওবা (৯) : ১১৩-১১৪


সূরা মুজাদালায় ‘মুয়ালাত' ও 'বারাআতের উপরোক্ত নীতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।


ইরশাদ হয়েছে—

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ تَوَلَّوْا قَوْمًا غَضِبَ اللهُ عَلَيْهِمْ مَا هُمْ مِنْكُمْ وَلَا مِنْهُمْ وَيَحْلِفُونَ عَلَى الْكَذِبِ وَهُمْ يَعْلَمُونَ . أَعَدَّ اللهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ . اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ فَلَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ ، لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ . يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيَحْلِفُونَ لَهُ كَمَا يَحْلِفُونَ لَكُمْ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ عَلَى شَيْءٍ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْكَاذِبُونَ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنْسَاهُمْ ذِكْرَ اللهِ أُولَئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ الشَّيْطَانِ هُمُ الْخَاسِرُونَ • إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ . كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ • لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ


🔰* তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ কর নাই যারা, আল্লাহ যে সম্প্রদায়ের প্রতি রুষ্ট তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে? তারা তোমাদের দলভুক্ত নয়, তাদের দলভুক্তও নয় এবং তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।


🔰* আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি। তারা যা করে তা কত মন্দ! 


🔰* তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে, আর তারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে; অতএব তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। 


🔰* আল্লাহর শাস্তির মুকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কোনো কাজে আসবে না; তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। 


🔰* যেদিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদের সকলকে, তখন তারা আল্লাহর নিকট সেইরূপ শপথ করবে যেইরূপ শপথ তোমাদের কাছে করে এবং তারা মনে করে যে, এতে তারা ভালো কিছুর উপর রয়েছে। সাবধান! তারাই তো প্রকৃত মিথ্যাবাদী ।


🔰* শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে; ফলে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানেরই দল। সাবধান! শয়তানের দল অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। 


🔰* যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা হবে চরম লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত। 


🔰* আল্লাহ সিদ্ধান্ত করেছেন, আমি অবশ্যই বিজয়ী হব এবং আমার রাসূলগণও। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। 


🔰* তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমন কোনো সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীগণকে- হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা তাদের জ্ঞাতি- গোত্র তাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করেছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা।

তিনি তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে।

-আল মুজাদালা (৫৮) : ১৪-২২


আরো ইরশাদ-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونَكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ حَبَالًا وَدُّوا مَا عَتُمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُحْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ إِنْ كُنتُمْ تَعْقِلُونَ . مَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ يَفْرَحُوا بِذَاتِ الصُّدُورِ • إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ا وَإِنْ


🔰* হে মু'মিনগণ! তোমাদের আপনজন ছাড়া অন্য কাউকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের ক্ষতি করতে ত্রুটি করবে না; যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর।

দেখ, তোমরাই তাদেরকে ভালবাস কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না অথচ তোমরা সব কিতাবে ঈমান রাখ আর তারা যখন তোমাদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, 'আমরা বিশ্বাস করি; কিন্তু তারা যখন একান্তে মিলিত হয় তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে তারা নিজেদের অঙ্গুলির অগ্রভাগ দাঁতে কেটে থাকে।

বল, “তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মর।' অন্তরে যা রয়েছে সে সম্বন্ধে আল্লাহ সম্যক অবগত।

তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। তোমরা যদি ধৈর্যশীল হও এবং মুত্তাকী হও তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না । তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে আছেন।-আলে ইমরান ৩ : ১১৮-১২০


এখানে কিছু অবুঝ মুসলমানের ভুল ধারণারও সংশোধন করা হয়েছে, যারা সামাজিক সৌজন্যের নামে ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম শিথীলতার শিকার হয় এবং বলে, “তারা অমুসলিম হলেও তো আমাদের ভাই/বন্ধু!' (নাউযুবিল্লাহি নিঃসন্দেহে এটা চরম নির্বুদ্ধিতা।

কেউ যদি বুঝে শুনে একথা বলে তাহলে এটাই তার ‘মুনাফিক' হওয়ার স্পষ্ট নিদর্শন। আমাদের তরফ থেকে তো এই নির্বুদ্ধিতা যে, এদের প্রতি প্রীতি ও ভালবাসা পোষণ করতে থাকব অথচ তারা তাদের ভ্রান্ত ধর্ম বা মতবাদে এতই কট্টর যে, আমাদের প্রতি ভালবাসা তো দূরের কথা, আমাদেরকে তারা হীনতম শত্রু মনে করে এবং আমাদেরকে যন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষেত্রে, দেশে দেশে আমাদের ভাইবোনদের ব্যাপক হত্যা-নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোনো অপচেষ্টা বাদ রাখে না ।


এ বিষয়ে এই আয়াতগুলো মনোযোগের সাথে পাঠ করুন : ২ : ২৫৭; ৩ : ২৮; ৪ : ১৩৯; ৫ : ৫১, ৫৭, ৮১; ৮ : ৭২-৭৩; ৯ : ২৩-২৪, ৬৭, ৭১; ৪৫ : ১৯

সহযোগিতা করা না-করার মানদণ্ড


ইসলামী আদর্শে সহযোগিতা করা বা না-করার যে মানদণ্ড উপরে বলা হয়েছে তার সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআনে কারীমের কয়েকটি আয়াত দেখুন :


وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ أَنْ صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَنْ تَعْتَدُوا وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ


তোমাদেরকে মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনোই সীমালংঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।-আল মাইদাহ (৫) : ২


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ ! إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ


🔰* হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।-আল মাইদাহ (৫) : ৮


হাদীস শরীফে আছে-

ليس منا من دعا إلى عصبية وليس منا من قاتل على عصبية وليس منا من مات على عصبية.


অর্থাৎ যে আসাবিয়্যার দিকে ডাকে সে আমাদের দলভুক্ত নয়, এবং সে- ও আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যার ভিত্তিতে লড়াই করে। আর সে-ও না যে আসাবিয়্যার উপর মৃত্যুবরণ করে।-সুনানে আবু দাউদ,হাদীস ৫১২১


আরেক হাদীসে আছে-

يا رسول الله ما العصبية؟ قال : أن تعين قومك على الظلم.


আল্লাহর রাসূল! ‘আসাবিয়্যাহ' কী? ইরশাদ করলেন, (আসাবিয়্যাহ হল) নিজ গোত্রের জুলুমে সহযোগী হওয়া।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১১৯


এ হাদীসে ‘আসাবিয়্যা'র অর্থও স্পষ্ট হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির, দলের, মতবাদের বা সম্প্রদায়ের শুধু এজন্য সহযোগিতা করা যে, সে আমাদের। সে ম্যায়ের উপর থাকুক কি অন্যায়ের উপর, সঠিক হোক বা ভুল। অথচ ইসলামে সহযোগিতার ভিত্তি নেক আমল ও খোদাভীরুতা। গুনাহ ও জুলুমে কারো সহযোগিতা করা হারাম সে যতই নিকটবর্তী হোক না কেন; বরং জালিমকে জুলুম থেকে নিবৃত্ত রাখাই হচ্ছে তার সহযোগিতা-

যেমনটা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—


انصر أخاك ظالما أو مظلوما، فقال رجل : يا رسول الله ! أنصره إذا كان مظلوما، أفرأيت إذا كان ظالما، كيف أنصره؟ قال : تحجزه أو تمنعه من الظلم، فإن ذلك نصره.


তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, যখন সে মাজলুম তখন, যখন সে জালেম তখনও। এক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মজলুমকে সাহায্যের বিষয়টি তো বুঝলাম, কিন্তু জালেমকে কীভাবে সাহায্য করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখবে।

আর এটাই হল, জালেমকে সাহায্য করা।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৬৭৪৭; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৯৫২


১৫. ঈমান অতি সংবেদনশীল, মুমিন ও গায়রে মুমিনের মিশ্রণ তার কাছে সহনীয় নয়


ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন, ঈমানের বিষয়টি অতি নাজুক ও সংবেদনশীল । ইসলাম এটা বরদাশত করে না যে, মুসলিম উম্মাহ অন্য কোনো জাতির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে কিংবা অন্যদের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাবে। ইসলাম তার অনুসারীদের যে পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত দান করেছে তাতে এমন অনেক বিধান আছে, যার তাৎপর্যই হচ্ছে, মুসলিমের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্রমণ্ডিত হওয়া।

যেমনটা সে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রের অধিকারী চিন্তা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিধি-বিধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে।

বেশভূষা, আনন্দ-বেদনা, পর্ব- উৎসব, সংস্কৃতি ও জীবনাচার বিষয়ে শরীয়তের আলাদা অধ্যায় ও আলাদা বিধিবিধান আছে, যার দ্বারা জাতি হিসেবে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা সৃষ্টি হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে এই বিধানগুলোর অনুসরণ প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। আর এগুলোকে সত্য বলে মানা এবং অন্তর থেকে পছন্দ করা তো ঈমানের অংশ ।


তন্মধ্যে অমুসলিমের সাথে সম্পর্কের ধরন বিষয়ক যে সকল বিধান আছে, তা বিশেষভাবে মনোযোগের দাবিদার। তার মধ্যে একটি হুকুম হল, অমুসলিমদের পর্ব-উৎসব থেকে দূরে থাকা এবং তাদের ধর্মীয় নিদর্শনের প্রতি কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন থেকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকা।

তাছাড়া মুয়ালাত ও বারাআতের মৌলিক বিধান তো উপরে বলা হয়েছে, এখানে সে বিষয়ক শুধু দু'টি বিধান উল্লেখ করছি : এক. জানাযার নামায, দুই. মাগফিরাতের দুআ । 


এই দুই বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা এই যে, কোনো অমুসলিমের জানাযার নামায পড়া যাবে না এবং কোনো অমুসলিমের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা যাবে না। সে অমুসলিম পিতা হোক বা ভাই, উস্তাদ হোক বা মুরব্বি, নেতা হোক বা লিডার।

সীরাতে নববিয়্যাহর দিকে তাকান, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন চাচা আবু তালিবের জানাযার নামায পড়াননি অথচ তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতইনা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

সীরাত-তারীখ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখেন এমন যে কারোরই তা জানা আছে। এত সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং এত নিকটাত্মীয়তা সত্ত্বেও না তার জানাযা পড়েছেন, না তার জন্য দুআয়ে মাগফিরাত করেছেন।

এ বিষয়ে সকল নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের ঘটনাবলি এত প্রচুর যে, তা আলাদা গ্রন্থের বিষয়। এখানে মাসআলার সাথে সংশ্লিষ্ট শুধু দু'টি আয়াত দেখুন :


وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ


তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনও তার জানাযার সালাত পড়বে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না; তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।—আত তাওবা (৯) : ৮৪


مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ . وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأُ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهُ حَلِيمٌ


আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়, যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিশ্চিতই তারা জাহান্নামী। 


🔰* ইবরাহীম তাঁর পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাঁকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন তাঁর কাছে এটা সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল । ইবরাহীম তো কোমলহৃদয় ও সহনশীল ।-আত তাওবা (৯) : ১১৩-১১৪


এখানে এ কথা উল্লেখ করে দেওয়া দরকার মনে করছি। তা হল, সাধারণ অবস্থায় অমুসলিম আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অন্য যে কোনো বিধর্মীর সাথে সদাচরণ শরীয়তে বৈধ ।


নিজের ঈমান-আকীদা এবং ইসলামী স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা রক্ষা করে তাদের সাথে সদাচরণ শুধু বৈধই নয় বরং শরীয়ত নির্দেশিতও বটে। এমনকি তাদেরকে নফল দান-সদকা দ্বারা সাহায্য-সহযোগিতা করাও জায়েয।


এছাড়া কুরআন মাজীদের এ হুকুম তো সকলের জন্যই প্রযোজ্য—

وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ . وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ


ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করুন উৎকৃষ্টের দ্বারা; ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে। এই গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই, যারা ধৈর্যশীল, এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা মহাভাগ্যবান।-

সূরা হা- মীম আস-সাজদা, (৪১) ৩৪-৩৫


যদিও আমাদের কিছু অবুঝ শ্রেণীর মুসলমান ভাইয়ের কর্মপন্থা এর ব্যতিক্রম। তাদেরকে নিজের এবং নিজের গুরুজন ও মুরব্বী সম্পর্কে অতি সংবেদনশীল দেখা যায়। তাদের ব্যাপারে কেউ সামান্য উচ্চ-বাচ্য করলে তার আর রক্ষা নেই।


পক্ষান্তরে কোনো বেদ্বীন-মুলহিদ ইসলাম ও ইসলামের সুমহান গ্রন্থ আল-কুরআন, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শিআরে ইসলাম সম্পর্কে যত অশ্রাব্য গালি-গালাজ, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করুক না কেন এ নিয়ে তাদের কোনোই মাথাব্যাথা নেই। অথচ সামাজিক সৌজন্য তো আলাদা বিষয়। আর ক্ষমা-মার্জনা তো হতে পারে ব্যক্তিগত হক সম্পর্কে এবং তা উচিতও। কিন্তু যেখানে দ্বীন-ঈমানের প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং ইসলাম ও শিআরে ইসলামের প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে সেখানে তো প্রত্যেক মুসলমানকে শরীয়তের গণ্ডিতে থেকে সাধ্যানুযায়ী ঈমানী গায়রত ও মর্যাদাবোধের পরিচয় দেওয়া কর্তব্য।

অবশ্য এর পন্থা ও উপায় কী হবে এবং শ্রেণীভেদে কার উপর কী ধরনের দায়িত্ব বর্তাবে তা বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নেওয়া জরুরি।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।


১৬. ঈমান পরীক্ষার উপায়

মানুষের জন্য ঈমানের চেয়ে বড় কোনো নেয়ামত নেই। এই নেয়ামতের কারণে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবে, আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারী করবে এবং এর সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী

মেহনত করবে ।


সকাল-সন্ধ্যায় মনে-প্রাণে বলবে-

ربا وبالإسلام دينا وبمحمد نبيا رضیت


আমি রব হিসেবে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, দ্বীন হিসেবে ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট আর নবী হিসেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সন্তুষ্ট ।


أصبحنا وأصبح الملك لله، والحمد لله ، لا إله إلا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير


এই সকালে (সন্ধ্যা বেলায় 'kai” এই সন্ধ্যায়) আমরা আল্লাহর, গোটা রাজত্ব আল্লাহর এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর। কোনো মাবূদ নেই আল্লাহ ছাড়া, তিনি এক, তার কোনো শরীক নেই। তাঁরই রাজত্ব, এবং তাঁরই প্রশংসা । আর তিনি সর্বশক্তিমান ...


এবং

اللهم ما أصبح بي من نعمة أو بأحد من خلقك فمنك وحدك لا شريك لك، فلك الحمد ولك الشكر.


ইয়া আল্লাহ, এই সকালে (সন্ধ্যা বেলায় : এই সন্ধ্যায়) যা কিছু নেয়ামতের আমি অধিকারী হয়েছি বা তোমার কোনো সৃষ্টি অধিকারী হয়েছে তা একমাত্র তোমারই পক্ষ হতে। তোমার কোনো শরীক নেই। সুতরাং তোমারই প্রশংসা এবং তোমারই জন্য শোকরগোযারী ।


ঈমানের লালন ও বর্ধন এবং সংস্কার ও সুরক্ষার জন্য জ্ঞান-গবেষণা এবং কর্ম ও দাওয়াতের অঙ্গনে কী কী পদক্ষেপ ব্যক্তিগতভাবে ও সম্মিলিতভাবে নিতে হবে এই মুহূর্তে তা আলোচনা করা উদ্দেশ্য নয় । 


এখন শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে নিবেদন করছি। আর তা এই যে, আমরা প্রত্যেকে যেন মাঝে মধ্যে নিজের ঈমান পরীক্ষা করি, যে-আল্লাহ না করুন- আমাদের ঈমান শুধু মৌখিক জমা খরচ নয় তো। এমন তো নয় যে, আমাদের ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, যা ‘গ্রহণযোগ্য ঈমান' এর মানদণ্ডে উত্তীর্ণই হয় না! আল্লাহ না করুন, যদি বাস্তব অবস্থা এমন হয় তাহলে এখনই নিজের ইসলাহ ও সংশোধন আরম্ভ করা উচিত ।


সহজতার জন্য কুরআন, সুন্নাহ ও সীরাতে সালাফের আলোকে নিজের ঈমান পরীক্ষার কিছু উপায় সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।


মনে রাখতে হবে, মৌলিকভাবে ঈমান যাচাইয়ের দুইটি পর্যায় আছে । প্রথম পর্যায় : আমার ঈমান ঠিক আছে কি না। দ্বিতীয় পর্যায় : সবলতা ও দুর্বলতার বিচারে আমার ঈমানের অবস্থান কোথায় ৷


এখানে শুধু প্রথম পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কথা নিবেদন করছি । এর জন্য নিম্নোক্ত উপায়গুলো ব্যবহার করা অধিক সহজ :


ক. আমার মাঝে কোনো কুফরী আকীদা নেই তো?

প্রথম কাজ এই যে, আমাদেরকে ইসলামী আকাইদ সঠিকভাবে জানতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে আমার মধ্যে ঐসব আকীদার পরিপন্থী কোনো কিছু নেই তো? যদি থাকে তাহলে আমাকে তৎক্ষণাৎ তওবা করতে হবে এবং ইসলামী আকীদার পরিপন্থী এই মতবাদকে বাতিল ও কুফরী বিশ্বাস করে এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে ।


কুরআন কারীমে মুশরিকদের, আখিরাতে অবিশ্বাসীদের, ইহুদি, নাসারা, মুনাফিকদের, পার্থিবতাবাদী, বেদ্বীন, নাস্তিকচক্রসহ সকল ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডন বিদ্যমান রয়েছে। চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে কিংবা কোনো নির্ভরযোগ্য তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীরের সাহায্যে কুরআন পাঠ করে এবং প্রয়োজনে কোনো আলিমের কাছে সবক পড়ে কাফিরদের প্রত্যেক শ্রেণীর বাতিল আকীদা সম্পর্কে জেনে নিজেদের বোধ-বিশ্বাসের পরীক্ষা নেয়া কর্তব্য যে, আমার মধ্যে ঐসবের কোনো কিছু নেই তো?


খ. আমার মধ্যে নিফাক নেই তো?

নিফাকের বিভিন্ন প্রকার আছে। এক. বিশ্বাসগত নিফাক। এ প্রবন্ধে এ নিয়েই আলোচনা করা উদ্দেশ্য। বিশ্বাসগত নিফাকের অর্থ, অন্তরে কুফরী মতবাদ বা ইসলাম বিদ্বেষ লালন করেও কথা বা কাজে মুসলিম দাবি করা ।

বিশ্বাসগত নিফাক হচ্ছে কুফরীর এক কঠিনতম প্রকার। এটা যার মধ্যে শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে নিবেদন করছি। আর তা এই যে, আমরা প্রত্যেকে যেন মাঝে মধ্যে নিজের ঈমান পরীক্ষা করি, যে-আল্লাহ না করুন- আমাদের ঈমান শুধু মৌখিক জমা খরচ নয় তো। এমন তো নয় যে, আমাদের ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, যা ‘গ্রহণযোগ্য ঈমান' এর মানদণ্ডে উত্তীর্ণই হয় না! আল্লাহ না করুন, যদি বাস্তব অবস্থা এমন হয় তাহলে এখনই নিজের ইসলাহ ও সংশোধন আরম্ভ করা উচিত ।


সহজতার জন্য কুরআন, সুন্নাহ ও সীরাতে সালাফের আলোকে নিজের ঈমান পরীক্ষার কিছু উপায় সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।


মনে রাখতে হবে, মৌলিকভাবে ঈমান যাচাইয়ের দুইটি পর্যায় আছে । প্রথম পর্যায় : আমার ঈমান ঠিক আছে কি না। দ্বিতীয় পর্যায় : সবলতা ও দুর্বলতার বিচারে আমার ঈমানের অবস্থান কোথায় ৷

এখানে শুধু প্রথম পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কথা নিবেদন করছি । এর জন্য নিম্নোক্ত উপায়গুলো ব্যবহার করা অধিক সহজ :


ক. আমার মাঝে কোনো কুফরী আকীদা নেই তো?

প্রথম কাজ এই যে, আমাদেরকে ইসলামী আকাইদ সঠিকভাবে জানতে হবে এবং চিন্তা করতে হবে আমার মধ্যে ঐসব আকীদার পরিপন্থী কোনো কিছু নেই তো? যদি থাকে তাহলে আমাকে তৎক্ষণাৎ তওবা করতে হবে এবং ইসলামী আকীদার পরিপন্থী এই মতবাদকে বাতিল ও কুফরী বিশ্বাস করে এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে ।


কুরআন কারীমে মুশরিকদের, আখিরাতে অবিশ্বাসীদের, ইহুদি, নাসারা, মুনাফিকদের, পার্থিবতাবাদী, বেদ্বীন, নাস্তিকচক্রসহ সকল ভ্রান্ত মতবাদের খণ্ডন বিদ্যমান রয়েছে। চিন্তা-ভাবনার সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে কিংবা কোনো নির্ভরযোগ্য তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীরের সাহায্যে কুরআন পাঠ করে এবং প্রয়োজনে কোনো আলিমের কাছে সবক পড়ে কাফিরদের প্রত্যেক শ্রেণীর বাতিল আকীদা সম্পর্কে জেনে নিজেদের বোধ-বিশ্বাসের পরীক্ষা নেয়া কর্তব্য যে, আমার মধ্যে ঐসবের কোনো কিছু নেই তো?


খ. আমার মধ্যে নিফাক নেই তো?

নিফাকের বিভিন্ন প্রকার আছে। এক. বিশ্বাসগত নিফাক। এ প্রবন্ধে এ নিয়েই আলোচনা করা উদ্দেশ্য। বিশ্বাসগত নিফাকের অর্থ, অন্তরে কুফরী মতবাদ বা ইসলাম বিদ্বেষ লালন করেও কথা বা কাজে মুসলিম দাবি করা।

বিশ্বাসগত নিফাক হচ্ছে কুফরীর এক কঠিনতম প্রকার। এটা যার মধ্যে আছে সে সরাসরি কাফির। তবে যথাযথ দলীল-প্রমাণ ছাড়া কারো বিষয়ে নিফাকের সন্দেহ করা বা কাউকে নিফাকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা জায়েয নয়। হ্যাঁ, যখন কারো কথা বা কাজের দ্বারা নিফাক প্রকাশিত হয়ে পড়ে, অন্তরে লালিত কুফরী আকীদা ও ইসলাম-বিদ্বেষ জিহ্বায়ও এসে যায় তখন তো এর বিষয়ে মুসলমানদের সাবধান হতেই হবে এবং সরকারকেও এই লোক সম্পর্কে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।


বিশ্বাসগত নিফাকের রূপগুলো কী কী কুরআন কারীমে তা ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো জেনে নিজেকে যাচাই করা উচিত, আমার মধ্যে এসবের কোনো কিছু নেই তো?

বিশ্বাসগত নিফাকের বিভিন্ন রূপ আছে। কয়েকটি এই :


🔰* ইসলামী শরীয়ত বা শরীয়তের কোনো বিধানকে অপছন্দ করা । 


🔰* ইসলামের, ইসলামের নবীর, ইসলামের কিতাবের, ইসলামী নিদর্শনের কিংবা ইসলামের কোনো বিধানের বিদ্রূপ বা অবজ্ঞা করা । 


🔰* ইসলামের কিছু বিশ্বাস ও বিধানকে মানা, আর কিছু না মানা । 


🔰* শরীয়তের কোনো বিধানের উপর আপত্তি করা বা তাকে সংস্কারযোগ্য মনে করা ।


🔰* ইসলামের কোনো অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন আকীদা বা বিধানের অপব্যাখ্যা করা।


গ. শাআইরে ইসলামের বিষয়ে আমার অবস্থান কী?

শাআইরে ইসলামকে ‘শাআইর’ এজন্য বলা হয় যে, তা ইসলামের চিহ্ন। প্রধান ‘শাআইর' এই : এক. ইসলামের কালিমা, দুই. আল্লাহর ইবাদত (বিশেষত নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব) তিন. আল্লাহর রাসূল, চার আল্লাহর কিতাব, পাঁচ. আল্লাহর ঘর কা'বা, অন্যান্য মসজিদ ও ইসলামের অন্যান্য পবিত্র স্থান, বিশেষত মসজিদে হারাম, মিনা, আরাফা, মুযদালিফা, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নববী। ছয়. হজ্বে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত ঐ পশু, যাকে ‘হাদী' বলে।

কুরআন মজীদে (২২ : ৩২, ৩০) 

আল্লাহ তাআলা ইসলামের শাআইর (নিদর্শনাবলী) কে ‘শাআইরুল্লাহ' ও 'হুরুমাতুল্লাহ' নামে ভূষিত করেছেন। এবং এই নিদর্শনগুলোর মর্যাদা রক্ষার আদেশ করেছেন। আর ইরশাদ করেছেন, এগুলোর মর্যাদা রক্ষা প্রমাণ করে অন্তরে তাকওয়া আছে, আল্লাহর ভয় আছে ।


নিজের ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় এই যে, আমি আমার অন্তরে খুঁজে দেখি, নিজের কথা ও কাজ পরীক্ষা করে দেখি আমার মাঝে শাআইরে ইসলামের ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে কি না। তদ্রূপ কেউ শাআইরুল্লাহর অবমাননা করলে আমার কষ্ট হয় কি না। এমন তো নয় যে, কেউ শাআইরের অবমাননা করছে, আর আমি একে তার ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে নীরব ও নির্লিপ্ত থাকছি? না আমার কষ্ট হচ্ছে, না এই অশোভন আচরণ সম্পর্কে আমার মনে ঘৃণা জাগছে, আর না এই বেআদবের বিষয়ে আমার অন্তরে কোনো বিদ্বেষ, না তার থেকে ও তার কুফরী কার্যকলাপ থেকে বারাআত (সম্পর্কচ্ছেদের) কোনো প্রেরণা!!


আল্লাহ না করুন, শাআইরের বিষয়ে এই যদি হয় আচরণ-অনুভূতি তাহলে ঐ সময়ই নিশ্চিত বুঝে নিতে হবে, এ অন্তর ঈমান থেকে একেবারেই শূন্য। সাথে সাথে সিজদায় পড়ে যাওয়া উচিত এবং তওবা করে, সর্বপ্রকার কুফর ও নিফাক থেকে ভিন্নতা ঘোষণার মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করা উচিত।


ঘ. আমার অন্তরে অন্যদের শাআইরের প্রতি ভালবাসা নেই তো?

ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্ম এবং দ্বীন ও আখিরাত-অস্বীকার সম্বলিত সকল ইজম সম্পূর্ণ বাতিল ও ভ্রান্ত। এদেরও ‘শাআইর’ ও নিদর্শন আছে, মিথ্যা উপাস্য ও আদর্শ আছে, যেগুলোর কোনো সারবত্তা নেই। কিন্তু ইসলাম এই সবের উপহাস ও কটুক্তিরও অনুমতি নিজ অনুসারীদের দেয় না। এক তো এ কারণে যে, তা ভদ্রতা ও শরাফতের পরিপন্থী, এছাড়া এজন্যও যে, একে বাহানা বানিয়ে এরা ইসলামের সত্য নিদর্শনের অবমাননা করবে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :


وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ كَذَلِكَ رَبَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ


আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদেরকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে; এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি অতঃপর তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকার্য সম্বন্ধে অবহিত করবেন।-আল আনআম : ১০৮


তো অন্যান্য কওমের রব, ইলাহ ও শাআইরের উপহাস ও কটূক্তি থেকে বিরত থাকা ইসলামের শিক্ষা, যা স্বস্থানে ইসলামী আদর্শের এক উল্লেখযোগ্য সৌন্দর্যের দিক। কিন্তু এর অর্থ কখনো এই নয় যে, তাদের রব ও মাবুদের (যা নিঃসন্দেহে অসার ও অসত্য) এবং এদের শাআইর ও নিদর্শনের (যা পুরোপুরি কল্পনা ও কুসংস্কার প্রসূত) সমর্থন ও সত্যায়ন করা হবে কিংবা এগুলোর প্রশংসা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হবে কিংবা অন্তরে আবেগ ও ভক্তি পোষণ করা হবে। কারণ এ তো সরাসরি কুফর। যদি তা বৈধ ও অনুমোদিত হয় তাহলে তো এরপরে ঈমান ও ইসলামের কোনো প্রয়োজনই অবশিষ্ট থাকে না। আর না উপরোক্ত বিশ্বাস ও কর্মের পরও ঈমানের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়। 

ভালোভাবে বোঝা উচিত, কোনো কিছুর কটূক্তি-অবজ্ঞা থেকে বিরত থাকার অর্থ এই নয় যে, ঐ বিষয়কে সম্মান করতে হবে বা সত্য মনে করতে হবে। তো কুফরের শাআইরের সম্মান বা . ভালবাসা হচ্ছে পরিষ্কার কুফর। আজকাল কিছু মানুষ দেখা যায়, যাদের দৃষ্টিতে নিজেদের তথা ইসলামী শাআইরের তো বিশেষ মর্যাদা নেই, এগুলোর অবমাননাও তাদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না। 

অথচ এরাই একাত্মতা প্রকাশ করে অন্যদের শাআইরের বিষয়ে। এরা অন্যদের ধর্মীয় উৎসবেও যোগদান করে এবং একে গৌরবের বিষয় মনে করে। একে তারা আখ্যা দেয় ‘সৌজন্য' ও ‘উদারতা'র চিহ্ন বলে। তাদের জানা নেই, এটা সৌজন্য ও উদারতা নয়, এ হচ্ছে সত্য দ্বীনের বিষয়ে শিথিলতা ও হীনম্মন্যতা এবং আপন জাতির সাথে বড় হীন ও গায়রতহীন আচরণ। হায়! তারা যদি বুঝত যে, কুফর ও শাআইরে কুফরের প্রীতি-আকর্ষণ, এসবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ এবং এসবের ভক্তি-উপাসনায় সন্তোষ বা আনন্দ প্রকাশও সরাসরি কুফর।

এই শ্রেণীর মানুষের মনে রাখা উচিত, কুরআনে কারীমের আয়াত-


إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلُهُمْ

অর্থ : ...তাহলে তো তোমরাও তাদের মতো হবে। (৪ : ১৪০ )

এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ

من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ : যে কোনো জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত। মোটকথা, নিজের ঈমানের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা যাচাইয়ের অন্যতম উপায় এ চিন্তা করা যে, অন্তরে বেদ্বীন সম্প্রদায়ের এবং দ্বীন ইসলামের বিদ্রোহীদের শাআইর-নিদর্শনের সমর্থন বা প্রীতি-আকর্ষণ নেই তো। যদি থাকে তাহলে তওবা করে নিজেকে সংশোধন করবে, আল্লাহ তাআলার কাছে শাআইরুল্লাহর ভক্তি-ভালবাসা এবং শাআইরুল্লাহর সংরক্ষণ ও সমর্থনের তাওফীক প্রার্থনা করবে। কুফরের শাআইরের প্রতি ঘৃণা ও সেগুলোর অসারতার বিষয়ে প্রত্যয় ও প্রশান্তি প্রার্থনা করবে।


ঙ. পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রে আমার নীতি উল্টা না তো?

জগতে পছন্দ-অপছন্দের অনেক মানদণ্ড আছে। মানুষের স্বভাবটাই এমন যে, এতে সৃষ্টিগতভাবেই কিছু বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে আর কিছু বিষয়ে অনাগ্রহ ও বিমুখতা বরং ঘৃণা ও বিদ্বেষ। কিন্তু কেউ যখন ইসলাম কবুল করে এবং ঈমানের সম্পদ লাভ করে তখন তার হাতে এসে তাঁর রাসূল যায় পছন্দ-অপছন্দের প্রকৃত মানদণ্ড। সে মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহ, ও তাঁর প্রদত্ত শরীয়ত।

সুতরাং যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে পছন্দনীয় এবং শরীয়তে কাম্য তা মুমিনের কাছে অবশ্যই পছন্দনীয় হবে যদিও অন্য কোনো মানদণ্ডে লোকেরা তা পছন্দ না করুক, কিংবা স্বয়ং তার কাছেই তা স্বভাবগতভাবে পছন্দের না হোক। 

আর যা কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অপছন্দের এবং শরীয়তে নিষিদ্ধ তা তার কাছে অবশ্যই অপছন্দনীয় হবে যদিও অন্য কোনো মানদণ্ডে লোকেরা তা পছন্দনীয় মনে করে কিংবা স্বভাবগতভাবে তার নিজেরও ঐ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে।

মুমিন সর্বদা নিজের পছন্দ-অপসন্দকে দ্বীন ও ঈমানের দাবির অধীন রাখে। সে তার স্বভাবের আকর্ষণকে আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির উপর কোরবান করে ৷


এজন্য ঈমান যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় যে, নিজের অন্তরকে পরীক্ষা করা তাতে পছন্দ-অপছন্দের মানদণ্ড কী। আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও শরীয়তের পছন্দ-অপছন্দ, না প্রবৃত্তির চাহিদা, নিজের গোত্র, দল, দলনেতা, পার্থিব বিচারে মর্যাদাবান শ্ৰেণী, শুধু শক্তির জোরে প্রবল জাতিসমূহের সংস্কৃতি, সাধারণের পার্থিব মতামত, জীবনের চাকচিক্য কিংবা এ ধরনের আরো কোনো কিছু?


যদি তার কাছে মানদণ্ড হয় প্রথম বিষয়টি তাহলে আল্লাহর শোকর গোযারী করবে আর যদি মানদণ্ড হয় দ্বিতীয় বিষয়গুলো তাহলে খালিস দিলে তওবা করবে। নিজের পছন্দকে আল্লাহ ও তাঁর বিধানের অধীন করবে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উসওয়ায়ে হাসানার (শরীয়ত ও সুন্নতের) অনুগামী করবে এবং ঈমানের তাজদীদ ও নবায়ন করবে।


আল্লাহর পছন্দকে অপছন্দ করা কিংবা আল্লাহর অপছন্দকে পছন্দ করা অথবা আল্লাহর বিধান অপছন্দকারীদের আংশিক আনুগত্য করা, এসবকে কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তাআলা মুরতাদ হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন এবং বলেছেন এগুলোর কারণে বান্দার সকল আমল নষ্ট হয়ে যায় ।


ইরশাদ হয়েছে—

إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُمْ . ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ . فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ .ذلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ


যারা নিজেদের কাছে সৎপথ ব্যক্ত হওয়ার পর তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয়। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা যারা অপছন্দ করে তাদেরকে তারা বলে ‘আমরা কোনো কোনো বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব।' আল্লাহ তাদের গোপন অভিসন্ধি অবগত আছেন। ফিরিশতারা যখন তাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের দশা কেমন হবে! এটা এজন্য যে, তারা তা অনুসরণ করে, যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তার সন্তুষ্টিকে অপ্রিয় গণ্য করে। তিনি এদের কর্ম নিষ্ফল করে দেন। (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ : ২৫-২৮)


একই সাথে পরিষ্কার ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ তাআলার পসন্দ হল ঈমান আর অপছন্দ হল কুফর ও শিরক। আল্লাহর কাছে ঈমান ও ঈমান সংশ্লিষ্ট সবকিছু পছন্দনীয়। আর কুফর, শিরক এবং কুফর ও শিরকের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু অপছন্দনীয়। 


ইরশাদ হয়েছে-

وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ وَيُبَيِّنُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ


মুশরিক নারীকে ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা বিবাহ করো না। মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও, নিশ্চয়ই মুমিন কৃতদাসী তাদের অপেক্ষা উত্তম। ঈমান না আনা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমরা বিবাহ দিও না, মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও, মুমিন কৃতদাস তাদের অপেক্ষা উত্তম। তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে এবং আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ অনুগ্রহে নিজ জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন।তিনি মানুষের জন্য স্বীয় বিধান সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তারা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।(আলবাকারা ২ : ২২১)


وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُعْجِبُكَ قَوْلُهُ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيُشْهِدُ اللَّهَ عَلَى مَا فِي قَلْبِهِ وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ ، وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ . وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ


আর মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, পার্থিব জীবন সম্পর্কে যার কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ কলহপ্রিয়। যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না। যখন তাকে বলা হয় ‘তুমি আল্লাহকে ভয় কর তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপে লিপ্ত করে, সুতরাং জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল। (আলবাকারা ২ : ২০৮-২০৬)


وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ . وَلَا تُعْجِبُكَ أَمْوَالُهُمْ وَأَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُونَ . الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ


তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে তুমি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং তাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে। আল্লাহ তো এর দ্বারাই পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান; তারা কাফির থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা দেহ ত্যাগ করবে।

(আততাওবা ৯ : ৮৪-৮৫) চ. নিজের ইচ্ছা বা পছন্দের কারণে ঈমান ছাড়ছি না তো?


নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা, স্বভাব ও রুচি-অভিরুচি, আত্মীয়তা ও সম্পর্কের আকর্ষণ ইত্যাদির সাথে যে পর্যন্ত ঈমানের দাবিসমূহের সংঘর্ষ না হয় ঐ পর্যন্ত ঈমানের পরীক্ষা হয় না। ঐ সকল বিষয়ের দাবি আর ঈমান- আকীদার দাবির মধ্যে একটিকে গ্রহণ করার পরিস্থিতি তৈরি হলেই ঈমানের পরীক্ষা হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিই হচ্ছে মুমিনের ঈমানী পরীক্ষার মুহূর্ত। আল্লাহ তাআলা বান্দার ঈমান পরীক্ষার জন্য, মুমিন ও মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য করার জন্য এমনসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন এবং দেখেন, পরীক্ষা কে সত্য প্রমাণিত হয়, কে মিথ্যা।

কার ঈমান খাঁটি সাব্যস্ত হয়, কার ঈমান নামকেওয়াস্তে ।


মুমিনের কর্তব্য, এই পরীক্ষার মুহূর্তে পূর্ণ সতর্ক থাকা। যেহেতু এসব ক্ষেত্রে দুটোকে গ্রহণের সুযোগ নেই তাই অবশ্যই তাকে কোনো একটি দিক প্রাধান্য দিতে হবে। এই প্রাধান্যের ক্ষেত্রে তাকে প্রমাণ দিতে হবে ঈমানের। যদি সে আল্লাহ, রাসূল, হিদায়েতের কিতাব, এবং দীন ও শরীয়তকে প্রাধান্যের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে এবং ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহের বিপরীতে নিজের ইচ্ছা ও চাহিদা, স্বভাবগত পছন্দ-অপছন্দ এবং আত্মীয়তা ও সম্পর্কের আকর্ষণ ও দুর্বলতাকে জয় করতে পারে তাহলে সে আল্লাহর কাছে সফল ও ঈমানী পরীক্ষায় কামিয়াব । 

পক্ষান্তরে যদি সে নিজের স্বভাব, কামনা-বাসনা ও পার্থিব সম্পর্ককে প্রাধান্যের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে আর এসবের খাতিরে ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহের কোরবান করে তাহলে সে ব্যর্থ ও ঈমানী পরীক্ষায় নাকাম। তার নিশ্চিত জানা উচিত, তার ঈমান শুধু নামকে ওয়াস্তের, অন্তর নিফাক দ্বারা পূর্ণ


কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষায় এই নীতি বারবার উচ্চারিত; মুসলিমের জন্য প্রাধান্যের মানদণ্ড হল আল্লাহ, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ঈমান ও ঈমানের দাবিসমূহ। এটি আল্লাহর পক্ষ হতেই নির্দেশিত সুতরাং একে যে প্রাধান্যের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করল না সে কুফরের রাস্তা অবলম্বন করল।


নমুনা হিসেবে কয়েকটি আয়াত দেখুন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا اَبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ . قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ


হে মুমিনগণ! তোমাদের পিতা ও ভাই যদি ঈমানের মোকাবেলায় কুফরিকে পছন্দ করে, তবে তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে তারাই জালিম । বল, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের সগোষ্ঠি, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত।'

আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।(আততাওবা ৯ : ২৩-২৪)


এর চেয়ে আরো স্পষ্ট 'নস' ও বাণীর প্রয়োজন আছে কি? আল্লাহর কাছে মুক্তি শুধু তখনই পাওয়া যাবে যখন আমাদের গ্রহণ বর্জনের মানদণ্ড হবে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর দ্বীন। আর পার্থিব সকল সম্পর্ক হবে এর অধীন যাতে মোকাবেলার সময় আমরা আল্লাহর ইচ্ছাকেই অগ্রগণ্য করতে যে ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করল এবং কুফরির জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখল তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য রয়েছে মহা শাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার হৃদয় ঈমানে অবিচলিত।

তা এই জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। তারাই ঐ সমস্ত লোক আল্লাহ যাদের অন্তর, কর্ণ ও চোখে মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই গাফেল। নিশ্চয়ই তারা আখেরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত । (আন নাহল ১৬ : ১০৬-১০৯)


যাদু ও কুফর থেকে তওবা করে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হযরত মূসা আ.-এর উপর ঈমান এনেছিলেন, ফিরাউন তাদেরকে হাত পা কেটে শূলিতে চড়ানোর হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু তাদের জবাব ছিল এই—


قَالُوا لَنْ نُؤْثِرَكَ عَلَى مَا جَاءَنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ إِنَّمَا تَقْضِي هَذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيا . إِنَّا آمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهَتْنَا عَلَيْهِ مِنَ السِّحْرِ وَاللَّهُ خَيْرٌ وَأَبْقَى . إِنَّهُ مَنْ يَأْتِ رَبَّهُ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَهُ جَهَنَّمَ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَا • وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَا • جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ مَنْ تَزَكَّى


তারা বলল ‘আমাদের কাছে যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দিব না। সুতরাং তুমি কর যা তুমি করতে চাও। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার।' আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছি যাতে তিনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করেন এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ তাও ক্ষমা করেন । 

আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী। যে তার প্রতিপালকের কাছে অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো আছে জাহান্নাম, সেখানে সে মরবেও না বাঁচবেও না এবং যারা তার নিকট উপস্থিত হবে মুমিন অবস্থায়, সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে সমুচ্চ মর্যাদা-স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই, যারা পবিত্র। (ত্বহা ২০ : ৭২-৭৬)


فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى . وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنْ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى . قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنتُ بَصِيرًا . قَالَ كَذَلِكَ أَتَنكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى


পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ আসলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখ কষ্ট পাবে না। ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করব অন্ধ অবস্থায়’। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? তিনি বলবেন, ‘এমনই আমার নিদর্শনাবলি তোমার কাছে এসেছিল কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হলে। (ত্বহা : ২০ : ১২৩-১২৬)


فَإِذَا جَاءَتِ الطَّامَّةُ الْكُبْرَى . يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ مَا سَعَى . وَبُرِّزَتِ الْجَحِيمُ لِمَنْ يَرَى ، فَأَمَّا مَنْ طَغَى . وَأَثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيا . فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى . وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى * فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى


অতঃপর যখন মহা সংকট উপস্থিত হবে। মানুষ যা করেছে তা সেই দিন স্মরণ করবে এবং প্রকাশ করা হবে জাহান্নাম দর্শকদের জন্য। অনন্তর যে সীমালঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় জাহান্নামই হবে তার আবাস। পক্ষান্তরে যে নিজ প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার আবাস। (আননাযিআত ৭৯ : ৩৪-৪১)


অপরাধীর উপর দয়ার কারণে হতে পারে কোনো বিচারক হ্রদ কায়েম করা থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, কক্ষনো না, আল্লাহর বিধান ও হুদকে সব কিছুর চেয়ে অগ্রগণ্য রাখ, যদি তোমরা মুমিন হও ।


في دين الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِئَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ .اللهِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ


ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী-তাদের প্রত্যেককে এক শত কশাঘাত করবে, আল্লাহর বিধান কার্যকরি করণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও; মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (আন নূর ২৪ : ২)


যদিও এখন হদ কায়েম করার বিষয়ে সরকারগুলোর যে অনীহা তার প্রধান কারণ সম্ভবত অপরাধীর প্রতি (অন্যায়) দয়া নয়; বরং মূল কারণ সাধারণত অপরাধ ও অশ্লীলতার সাথে মানসিক ঐক্য এবং ঐসব মুরব্বির ভয় যারা আপাদমস্তক বর্বরতায় ডুবে থেকে ইসলামের ইনসাফের আইনকে বর্বর বলে আখ্যায়িত করে। বলাবাহুল্য, এসব কারণে ইসলামী হুদূদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আরো বেশি ঈমানহীনতা ।


এটা সম্ভব যে, কিছু শাসক ঈমানদার হয়েও এবং ইসলামের বিধান ও দণ্ডকে ইনসাফপূর্ণ মনে করেও ভীরুতার কারণে তা কার্যকর করার সাহস করেন না । এদের উপর অবশ্য নিফাক ও ইলহাদের হুকুম জারি হবে না ।


তো নিবেদন করা হচ্ছিল যে, নিজের ঈমান যাচাই করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল, নিজের অবস্থা বিচার করা যে, আমার কাছে প্রাধান্যের মানদণ্ড ঈমান ও ইসলামের পরিবর্তে নিজের রুচি-অভিরুচি, প্রবৃত্তির চাহিদা কিংবা নিজের দল, গোত্র ও সম্প্রদায়ের পক্ষপাত নয় তো? যদি এমন হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ তওবা করে শুধু এবং শুধু ইসলামী প্রাধান্যের মাপকাঠি অবলম্বন করতে হবে এবং ঈমানের তাজদীদ ও নবায়ন করতে হবে।


আমলের সংশোধনের হিম্মত যদি এই মুহূর্তে না হয় তাহলে ঈমান তো দিলের বিষয়। ঈমানের সংশোধন তো তৎক্ষণাৎ হতে পারে। আর এর দ্বারা অন্তত আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধ থেকে তো নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে ।

ছ. আল্লাহকে হাকিম ও বিধানদাতা মেনে নিতে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই তো? (নাউযুবিল্লাহ)


এক তো হচ্ছে বর্তমানকালের বাস্তবতা যা আমাদেরই কর্মফল যে, ভূপৃষ্ঠের কোনো অংশ এমন নেই যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিধান কার্যকর, কিন্তু মুমিনমাত্রের জানা আছে যে, মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থা এ নয়, মুসলিম উম্মাহ তো পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ও শরীয়তের অধিকারী। যাতে বড় একটি অংশ রয়েছে রাজ্য-শাসন বিষয়ক।

উম্মাহর নেতৃত্ব ও পরিচালনা যাদের উপর ন্যস্ত তাদের ফরয দায়িত্ব ঐ নীতি ও বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, আমর বিল মারূফ, নাহি আনিল মুনকার (সকল মন্দের প্রতিরোধ ও প্রতিবেদ), ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও 'খিলাফত আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ' (নববী আদর্শ অনুযায়ী যমীনে খেলাফত পরিচালনা করা)-এর দায়িত্ব পালন করা, ইসলামী হদ, কিসাস ও তাযীর (দণ্ডবিধি) কার্যকর করা, সাধ্যানুযায়ী ইসলামী জিহাদের দায়িত্ব পালন করা, রাষ্ট্র পরিচালনা (আইন-বিচার, নির্বাহী) এর ক্ষেত্রে নতুন-পুরাতন জাহেলিয়াতের বিধি-বিধান এবং নতুন- পুরাতন সকল তাগূতি ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে ইসলামী বিধি- বিধানের আনুগত্য করা। এ হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা এবং এ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত অবস্থা :


وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَحْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنَا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ وأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ


তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীগণকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয় ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্য নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোনো শরিক করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী ।

তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।(আন নূর ২৪ : ৫৫-৫৬)


الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ


আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে । (হজ্ব ২২ : ৪১)


يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلُّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَاب


হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।

যারা আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা বিচারদিবসকে বিস্মৃত হয়ে আছে।(ছফ ৩৮: ২৬)


وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضٍ مَا أَنْزَلَ اللهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضٍ ذُنُوبِهِمْ وَإِنْ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ . أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ . يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ


কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি কর, তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ না কর এবং তাদের সম্বন্ধে সতর্ক হও যাতে আল্লাহ যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তারা তার কিছু থেকে তোমাকে বিচ্যুত না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখ যে, কোনো কোনো পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে বিপদাপন্ন করতে চান এবং মানুষের মধ্যে অনেকেই তো সত্যত্যাগী ।

তবে কি তারা জাহেলী যুগের বিধিবিধান কামনা করে? নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে কে শ্রেষ্ঠতর? হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (মায়েদা ৫ : ৪৯-৫১)


এই আয়াতগুলোতে মুসলিম শাসকদের কর্তব্য এবং তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি দুই-ই রয়েছে। এই বাস্তবতা স্মরণ রাখলে জানা যাবে, কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে শাসকদের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র হচ্ছে, যেখানে কুরআন-সুন্নাহ নিশ্চুপ এবং ইজমায়ে উম্মত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের ঐকমত্যপূর্ণ ফয়সালায় যার নজির নেই। অন্যভাষায়, নবউদ্ভূত ইজতিহাদী প্রসঙ্গসমূহ, মোবাহ ক্ষেত্রসমূহ এবং ব্যবস্থাপনাগত বিষয়াদি (যা মোবাহ্ বিষয়াদিরই অন্যতম বড় অংশ)-এই তিনটি ক্ষেত্রেই মুসলিম শাসকদের আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হতে পারে এবং এর অবকাশও তাদের আছে।


আর এর প্রথমটি অর্থাৎ নবউদ্ভূত ইজতিহাদী প্রসঙ্গসমূহের বিধানও সমসাময়িক ফকীহগণের উপর ন্যস্ত করা অপরিহার্য।


যেসব বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত নির্দেশনা আছে সেখানে হুবহু ঐ শিক্ষা ও নির্দেশনার অনুসরণ করা ও তা কার্যকর করা জরুরি। এসব বিষয়ে নতুন আঙ্গিকে বিন্যাস ও সংকলনের কাজ হতে পারে, কিন্তু তা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। তদ্রূপ সেসব থেকে বিমুখ হয়ে আলাদা আইন প্রণয়ন কিংবা তার স্থলে মানব রচিত (যে- ই হোক এর রচয়িতা) কোনো আইন গ্রহণের কোনো অবকাশ নেই । 

কেউ এমনটা করলে যদি নিজেকে অপরাধী মনে করে, অন্তরে আল্লাহর প্রতি, আখিরাতের প্রতি, তাঁর রাসূল, তাঁর কিতাব, তাঁর বিধান ও শরীয়তের প্রতি ঈমান থাকে, আর তার উপলব্ধি এই থাকে যে, আল্লাহর বিধান অনুসারেই রাজ্য পরিচালনা করা ফরয, এতেই আছে কল্যাণ ও কামিয়াবি কিন্তু ঈমানী কমযোরি ও বুযদিলির কারণে আমি তা করতে পারছি না। তাহলে অন্তরে ঈমান থাকার কারণে এবং ঐ হারাম কাজে নিজেকে অপরাধী মনে করার কারণে তার উপর কাফির-মুনাফিকের হুকুম আরোপিত হবে না। 

পক্ষান্তরে অবস্থা যদি এই হয় যে, আল্লাহর বিধান তার পছন্দ নয়, ইসলামকে সে ঘর ও মসজিদে আবদ্ধ রাখতে চায়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের নেতৃত্বে তার ঈমান নেই, আসমানী বিধিবিধানের উপর মানব রচিত আইন-কানুনের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই তার এই কর্ম ও অবস্থান সরাসরি কুফর। আর এই কুফরের সাথে কথায় বা আচরণে ঈমানের দাবি সরাসরি নিফাক ও মুনাফেকী ।


রাব্বুল আলামীনের হুকুম পড়ুন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا . أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلُّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ، وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا


হে মুমিনগণ যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী; কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তা পেশ কর আল্লাহ ও রাসূলের কাছে। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। তুমি তাদেরকে দেখ নাই যারা দাবী করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। 

তাদেরকে যখন বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার থেকে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে । (আন নিসা ৪ : ৫৯-৬১)


‘তাগূতে’র অর্থ আল্লাহর ঐ বিদ্রোহী বান্দা, যে আল্লাহর মোকাবেলায় নিজেকে বিধানদাতা মনে করে এবং মানুষের উপর তা কার্যকর করতে চায়।


প্রকৃতপক্ষে কোনো তাগূত ব্যক্তি বা দলের বানানো আইন-কানুন হচ্ছে সত্য দ্বীন ইসলামের বিপরীতে বিভিন্ন ‘ধর্ম’, যা থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করা ছাড়া ঈমান সাব্যস্ত হয় না। আল্লাহর বিরুদ্ধে কিংবা আল্লাহর সাথে তাগূতের উপাসনা বা আনুগত্য করা কিংবা তা বৈধ মনে করা, তদ্রূপ আল্লাহর দ্বীনের মোকাবেলায় বা তার সাথে তাগূতের আইন-কানুন গ্রহণ করা বা গ্রহণ করাকে বৈধ মনে করা সরাসরি কুফর ও শিরক । তাগূত ও তার বিধি-বিধান থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ছাড়া ঈমানের দাবি নিফাক ও মুনাফিকী ।


এই নিফাক থেকে বাঁচার ন্যূনতম উপায়, শাসক-জনগণ সকলেরই অন্তরে এই কামনা থাকা যে, হায়! আমাদের এখানে যদি ইসলামী বিধান কার্যকর হত! আমাদের দেশ ইসলামের বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হত! অন্তত অন্তরেও যদি পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ঈমান থাকে এবং ইসলামের রাজ্য চালনার নীতি ও বিধানের মর্যাদা মাহাত্ম্য ও ভালবাসা অন্তরে বিদ্যমান থাকে তাহলে এটাও অনেক বড় ব্যাপার। এর জন্যও আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করা কর্তব্য।


পক্ষান্তরে দিলের অবস্থা যদি এই হয় যে,-নাউযুবিল্লাহ-আল্লাহকে হাকিম ও শাসক মেনে নিতেই দ্বিধা ও সংকোচ কিংবা অস্বীকৃতি থাকে, রাজনীতি ও রাজ্য চালনায় আসমানী বিধানের 'অনুপ্রবেশ' কেন—এই যদি হয় মনের কথা তাহলে নিশ্চিত বুঝতে হবে, অন্তর ঈমান থেকে শূন্য এবং ঐ লোক ইসলামের গণ্ডি থেকে খারিজ। তাকে কুফর ও নিফাক থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে খাঁটি মনে তওবা করতে হবে এবং ইসলামের পূর্ণতা, পূর্ণাঙ্গতা ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার অবশ্য অনুসরণীয় হওয়ার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে পূর্ণ ইসলামে প্রবেশের মাধ্যমে ঈমানের নবায়ন করতে হবে, যাতে অন্তত ঈমানের পর্যায়ে আল্লাহ ও তার দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

এরপর হতে পারে যদি সদিচ্ছা থাকে—কখনো কর্মগত বিদ্রোহ থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে।


মনে রাখুন, হেদায়েত ও দ্বীনে হকের বিজয় কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের কাছে সহনীয় নয়। তাদের কাছে এটা খুবই অসহনীয় যে, শুধু আল্লাহর ইবাদত হবে এবং আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হবে। মুসলিম উম্মাহর ঈমানী তারাক্কী এবং উম্মাহ হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠা ওদের কাছে চরম গাত্রদাহের কারণ।

এখন যদি ইসলামের কালিমা পাঠ করেও আমার অবস্থা সেটাই হয় আর আমার বন্ধুত্বও হয় তাদের সাথেই তাহলে আমি কীভাবে ঈমানের দাবি করি? আমার আদর্শ তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ। কুরআন মজীদের বর্ণনায় তো তাঁদের অবস্থা এই-


مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَأَزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرًا عَظِيمًا


মাহম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মাঝে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের লক্ষণ তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাবে পরিস্ফূট থাকবে; তাওরাতে তাদের বর্ণনা এমন এবং ইনজিলেও তাদের বর্ণনা এমনই। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ, যা থেকে বের হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে যা চাষীর জন্য আনন্দদায়ক।

এই ভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধির দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের। (আলফাতহ ৪৮ : ২৯)


কাফির-মুশরিকদের এই ঘৃণা ও ক্রোধ অতীতেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে যে পর্যন্ত না তারা কুফর ও শিরক থেকে তওবা করে দ্বীনে হক কবুল করে। মুসলিম উম্মাহর ফরয-যদি নিজের ঈমান রক্ষা করতে হয়—ওদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা। এরপর কেউ যদি ওদের বন্ধুত্ব থেকে প্রভূত্বের আসনে সমাসীন করে এবং নিজেদের আদর্শ বানিয়ে নেয় তবে তাদের অবস্থা তো কুরআন মজীদে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে-


يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ . هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ


তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে।-সূরা আসসফ ৬১: ৮-৯


اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَها وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ . يُرِيدُونَ أَنْ يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَنْ يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ . هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ


তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের পন্ডিতগণকে এবং সংসারবিরাগীগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম তনয় মসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। তারা যাকে শরিক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র! তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কাফেররা অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ছাড়া অন্য কিছু চান না। মুশরিকরা অপ্রীতিকর মনে করলেও অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূল প্রেরণ করেছেন । (আততাওবা ৯ : ৩১-৩৩) .


হাদীসে আছে, ইয়াহূদ-নাসারা নিজেদের আহবার-রোহবানের উপাসনা করত না, এখনও করে না। তবে ওরা তাদেরকে হালাল-হারাম নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিল। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ওরা নিজেদের আহবার-রোহবানকে 'রব' হিসেবে গ্রহণ করেছে। (দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩০৯৫) অথচ ‘রব’ শুধু আল্লাহ; না তার রব-গুণে কেউ শরীক হতে পারে, না ইলাহ গুণে।

এ কারণে যে কেউ আল্লাহর আহকাম- হুদূদ ও আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তের বিপরীতে কারো জন্য আইন প্রণয়নের অধিকার স্বীকার করে তবে সে সরাসরি শিরকে লিপ্ত হয় এবং বস্তুত ঐ ব্যক্তিকে নিজের 'রব' হিসেবে গ্রহণ করে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সর্বপ্রকারের কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন। আমীন ।


জ. আমি সাবীলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হচ্ছি না তো?

সর্বশেষ কথা এই যে, কুরআন-সুন্নাহয় সীরাতে মুসতাকীম ও হেদায়েতের উপর অবস্থিত নাজাতপ্রাপ্ত লোকদের পথকে ‘সাবীললু মুমিনীন' বলা হয়েছে এবং এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। 


ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا


কারো কাছে সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব। আর তা কত মন্দ আবাস ! (আন নিসা ৪ : ১১৫)


এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; 'হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে দাও মহাঅভিসম্পাত। (আলআহযাব ৩৩ : ৬৪-৬৮)


কিন্তু জবাব পাওয়া যাবে যে-

قَالَ لِكُلِّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لَا تَعْلَمُونَ


আল্লাহ বলবেন,‘প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না। (আলআ'রাফ ৭ : ৩৮)


এবং নেতারা বলবে :

فَمَا كَانَ لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْسِبُونَ


আমাদের উপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সুতরাং তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন কর। (আলআরাফ ৭ : ৩৯)


তওবার দরজা খোলা আছে মওত হাজির হলে তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই সংশোধনের সময়। খাঁটি তওবা করলে আল্লাহ তাআলা কুফর-শিরক ও নিফাকসহ বড় বড় অপরাধও মাফ করে দেন। শর্ত হচ্ছে, ‘তাওবায়ে নাসূহ' খালিস তওবা। যে তওবাতে সকল প্রকার কুফর শিরক মুনাফেকী বর্জনের পাশাপাশি সকল প্রকার গুনাহ থেকে বাঁচার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও কর্ম সংশোধন এবং সাধ্যমত অতীত জীবনের ক্ষতিপূরণও শামিল-


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَتُرِيدُونَ أَنْ تَجْعَلُوا لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُبِينًا . إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا . إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَاعْتَصَمُوا بِاللَّهِ وَأَخْلَصُوا دِينَهُمْ لِلَّهِ فَأُولَئِكَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ وَسَوْفَ يُؤْتِ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ أَجْرًا عَظِيمًا . مَا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآمَنْتُمْ وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا


হে মুমিনগণ! মুমিনগণের পরিবর্তে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ দিতে চাও? মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য কখনো কোনো সহায় পাবে না। কিন্তু যারা তওবা করে, নিজেদেরকে সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনে একনিষ্ঠ থাকে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনগণকে আল্লাহ অবশ্যই মহাপুরস্কার দিবেন। তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আন তবে তোমাদের শাস্তিতে আল্লাহর কি কাজ? আল্লাহ পুরস্কারদাতা সর্বজ্ঞ। (আননিসা ৪ : ১৪৪ - ১৪৭ )


ইয়া আল্লাহ! আমরা অন্তর থেকে ঈমান আনছি এবং আপনার শোকর আদায় করছি । আপনি কবুল করুন। আমীন ।

👇ঈমান সবার আগে👇

🔰বই ডাউনলোড করুন🔰

Post a Comment

0 Comments