Ticker

10/recent/ticker-posts/

আন্তরিক তাওবা == ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি (রঃ)


🔰ভূমিকা🔰

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য চাই। আমরা তাঁর মাগফেরাত (ক্ষমা) ও হেদায়াত (পথনির্দেশনা) কামনা করি। আমরা আমাদের নফসের অনিষ্ট ও খারাপ আমলের কুফল থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্ৰাৰ্থনা করি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ বলেন:


🔎“হে ঈমানদারগণ! তোমরা প্রকৃত ভীতি সহকারে আল্লাহকে ভয় করো। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১০২)


🔎“হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত করো, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ২১)


🔎“হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অগণিত নারী ও পুরুষ। আর আল্লাহকে ভয় করো যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে কোন কিছু চেয়ে থাকো। এবং আত্মীয় পরিজনদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন আছেন।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত ১)


🔎“হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। তিনি তোমাদের আমল সংশোধন করবেন এবং গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করে সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।” (সুরা আল-আহযাব, আয়াত ৭০- ৭১)


সবচাইতে নির্ভুল ও সঠিক কিতাব হলো আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ হলো হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদর্শ। সবচাইতে খারাপ হলো বিদআত (দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন), আর প্রত্যেক বিদআতই হলো পথভ্রষ্টতা। প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা, আপনাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে, গুনাহ করার সাথে সাথে ক্ষমা চাওয়া ও আল্লাহর কাছে তাওবা করা ফরজ। 

তাওবা আল্লাহর রাস্তায় চলা মানুষের অনুসরণীয় পথ, মুমিনের রসদ। এটা দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্যের বড় পুঁজি। আন্তরিক তাওবার মাধ্যমেই কেবল আখিরাতে নাজাত ও পুরষ্কার মিলবে। তাওবাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। তাওবা পাপরাশী মুছে দেয়, ভুল ত্রুটি ঢেকে রাখে, মানুষের হৃদয় ও মনকে সঠিক পথ দেখায়। এ কারণে সলফে সালেহীনরা নিয়মিত ভাল আমল করা সত্ত্বেও অল্প ঘুমাতেন, ভোরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। তারা জানতেন যে তাদের আমলের আরও উন্নতি করার সুযোগ আছে। 

এজন্যই তাদের একজন বলেছিলেন, “আমাদের তাওবা আরো তাওবা দাবী করে।” আরেকজন বলেছিলেন, “অভিনন্দন তাকে যে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটি সঠিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছে।”


এই ছিল তাদের জীবন। পরবর্তী যুগের লোকেরা কামনা বাসনার পিছনে ছুটলো। তারা ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার মোহে ডুবে গেলো, তাদের কাছে আখেরাত হয়ে গেলো মূল্যহীন। তারা দিনে রাতে গুনাহ করতে লাগলো, কিন্তু উপলব্ধি করলো না যে আল্লাহ মহা প্রতাপশালী ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। যে ব্যক্তি পরম ক্ষমতাবান ও দয়াময়ের কাছে তাওবা করে না তার জন্য তো ব্যর্থতা ও বিফলতাই অনিবার্য হয়ে পড়ে।

সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা, আসুন আমরা গর্ব, অহংকার, হিংসা, ঘৃণা ও আত্মপ্রসাদ ইত্যাদি থেকে মুক্ত হয়ে খোলা ও পরিষ্কার মন নিয়ে আল্লাহর দিকে বারবার ফিরে আসি, যাতে করে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে পারি।


এই বইতে আমি তাওবা, তার গুণাগুণ, শর্ত ও প্রাসংগিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। যদি আমি সঠিক বলি, তবে তা আল্লাহর রহমত। আর ভুল-ভ্রান্তির দায়ভার একান্তই আমার আর শয়তানের। প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তানের কাছ থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ, আমার এই প্রচেষ্টাকে শুধুমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য কবুল করুন। এর রচয়িতাকে আপনি ক্ষমা করুন। আপনিই সর্বশক্তিমান।


🔰তাওবা এর আক্ষরিক অর্থ🔰


আল-কামুস (বিখ্যাত আরবি অভিধান) অনুযায়ী, তাওবা শব্দের মানে গুনাহ থেকে ফিরে আসা। এই শব্দ ব্যবহার করা হয় যখন বান্দাহ গুনাহ করার পর তার রবের দিকে ফিরে আসে।

🔎আল হালিমি (রঃ) বলেন, এর (তাওবা) ধরণ হলো এমন, যেন বান্দাহ আল্লাহর কাছ থেকে (গুনাহ করার মাধ্যমে) পালিয়ে গিয়েছিল এবং আবার তার প্রভুর কাছে ফিরে এসেছে। (আল মিনহাজ ফী শুয়াবুল ঈমান : ৩/২১)


🔰তাওবার প্রয়োজনীয়তা ও তার গুণাগুণ🔰


আপনাদের জানা প্রয়োজন, অতীত ও বর্তমানের সমস্ত আলেমগণ সর্বসম্মতিক্রমে এই বিষয়ে একমত যে, ছোট বড় সমস্ত গুনাহ থেকে সাথে সাথে তাওবা করা ওয়াজিব। আল্লাহর নাযিলকৃত বাণীতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়:

🔎“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর সামনে তাওবা করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা আন-নুর আয়াত ৩১)


🔎“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা।” (সুরা আত-তাহরিম, আয়াত ৮)

“আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। অতঃপর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ করো। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন।” (সুরা হুদ, আয়াত ৩)


🔎“তিনি তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, গুনাহসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমাদের কৃত বিষয় সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবগত আছেন।” (সুরা আশ-শুরা, আয়াত ২৫)


🔎“অতঃপর যে স্বীয় অত্যাচারের পর তাওবা করে এবং সংশোধিত হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩৯)


🔎“তারা কেন আল্লাহর কাছে তাওবা করে না, ক্ষমা প্রার্থনা করে না? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত ৯৮)


🔎“কিন্তু যারা তাওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎ কর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহকে ভালো আমল দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সুরা আল-ফুরকান, আয়াত ৭০)


🔎আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই বিষয়ে অসংখ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরুপ:


🔎আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন সত্তুরবারের বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তাওবা করি।” (সহীহ বুখারী)


🔎আম্মার ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “হে মানুষেরা! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো এবং ক্ষমা চাও। কেননা আমি প্রতিদিন একশত বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।” (সহীহ মুসলিম)


🔎আবু মুসা আল-আশয়ারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “আল্লাহ রাতের বেলা তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করেন যাতে দিনের গুনাহগার বান্দাদের ক্ষমা করতে পারেন। আবার তিনি দিনের বেলা তাঁর রহমতের হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের গুনাহগার বান্দাদের ক্ষমা করতে পারেন। এইভাবে তিনি ক্ষমা করতে থাকবেন যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হয় (কেয়ামতের সময় ঘনিয়ে আসে)।” (সহীহ মুসলিম)।


🔎আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবার আগ পর্যন্ত যে ব্যক্তিই তাওবা করবে, আল্লাহ তাকেই ক্ষমা করবেন।” (সহীহ মুসলিম)


🔎ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “আদম সন্তানের যদি পাহাড় পরিমাণ সোনাও থাকে তবুও সে আরো চায়। এমন কি কবরে পৌঁছার আগ পর্যন্ত তার পেট সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু আল্লাহ তাকেই ক্ষমা করেন যে তাওবা করে।” (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)


🔎আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “আল্লাহর কোন বান্দাহ যখন তাঁর দিকে ফিরে আসে এবং তাওবা করে, আল্লাহ তখন সেই মুসাফিরের চাইতেও বেশী খুশী হন, যে তার উট হারিয়ে ফেলেছে। উটের উপর ছিল তার খাদ্য-পানীয়-সম্বল। তখন সেই মুসাফির সব আশা হারিয়ে হতাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জেগে সে দেখে, তার উট তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দের আতিশয্যে সে তখন বলে উঠে, হে আল্লাহ আপনি আমার গোলাম, আমি আপনার মালিক (এই লোকটি যে পরিমাণ খুশি হয়, বান্দাহ তাওবা করলে আল্লাহ তার চাইতেও বেশি খুশি হন)।” (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)


🔎আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “মৃত্যুশয্যায় উপনীত হবার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবা কবুল করেন”।

🔴তাওবা সম্পর্কে সলফে সালেহীনদের বক্তব্য🔴


এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) কে এমন একটি পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো, যা সে করতে চেয়েছিল (কিন্তু করেনি)। তিনি লোকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আবার যখন ফিরলেন তখন তার চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বললেন, “বেহেশতের আটটি দরজা আছে যার প্রতিটি খোলা হয় এবং বন্ধ করা হয় শুধুমাত্র তাওবার দরজা ছাড়া। একজন ফেরেশতা এই দরজা পাহারা দিচ্ছেন যাতে তা বন্ধ না হয়। সুতরাং তাওবা কর, হতাশ হয়ো না।


🔎তালাক ইবনে হাবীব (রঃ) বলেন, “একজন বান্দাহ কখনোই আল্লাহর হক (অধিকার) পরিপুর্ণ ভাবে আদায় করতে পারে না। তাই তোমরা সকাল সন্ধ্যা আল্লাহর কাছে তাওবা কর।”


🔎সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব (রঃ) আল-কোরআনের আয়াত “যদি তোমরা সৎ হও, তবে তিনি তাওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।” (সুরা আল-ইসরা, আয়াত ২৫) উল্লেখ করতেন এমন ব্যক্তি সম্পর্কে যে পাপ করে এরপর তাওবা করে এরপর আবার পাপ করে এবং আবারো তাওবা করে।


🔎মুজাহিদ (রঃ) বলেন, “যে ব্যাক্তি সকাল-সন্ধ্যা/দিনে রাতে আল্লাহর কাছে তাওবা করে না সে যালেমদের (অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত।”


🔎লোকমান (আলাইহিস সালাম) তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, “বৎস! তাওবা করতে দেরি করো না। কারণ মৃত্যু যে কোন মুহুর্তেই এসে যেতে পারে।”


🔎আব্দুল্লাহ ইবনে হাবীব (রঃ) বলেন, “প্রতিবার গোনাহের সময় আল্লাহর যে ক্রোধ, তুমি কখনোই তা সহ্য করতে পারবে না। তাই সকাল সন্ধ্যা তাওবা কর।”


🔎ফুযাইল ইবনে আয়ায (রঃ) জিহাদে যাওয়ার আগে মুজাহিদীনদের বলতেন, “তাওবার উপরে অটল থাকো। এটি তোমাকে এমন জিনিস থেকে রক্ষা করবে যা থেকে তোমার তলোয়ার তোমাকে রক্ষা করতে পারবেনা।”


🔎হাসান (রঃ) বলতেন “হে আদম সন্তানেরা, গড়িমসি করো না। আজই তোমাদের দিন, আগামীকাল নয়। আমি এমন সব মানুষের সাথে মিশেছি যারা অর্থ সম্পদের চাইতে নিজেদের জীবন নিয়ে বেশী চিন্তিত ছিলেন।”


🔎এই ছিল তাওবা সম্পর্কে আমাদের পূর্বসুরীদের অনুভূতি। তাঁরা বুঝতে পারতেন যে যদি কোন ব্যক্তি পুঁজি বিনিয়োগ করে লাভ ছাড়া তার পুরোটাই খুইয়ে বসে, তবে শোক করা ছাড়া তার উপায় থাকবে না। তদ্রুপ আমাদের এই জীবন মুল্যবান নিঃশ্বাসের যোগফল। এটি আমাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজির মতো যা লাভ হিসেবে জান্নাত এনে দিবে। কিভাবে তাওবা ছাড়া কোন মানুষ এই বিনিয়োগের অপচয় করতে পারে?


🔎একজন মানুষের যৌবন ও বার্ধক্য, সমৃদ্ধি ও দারিদ্র্য, সর্বাবস্থায় তাওবা করা জরুরী। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (রঃ) বলেন, “তাওবার ষ্টেশন হলো একজন মুসাফিরের প্রথম ষ্টেশন, মাঝের ষ্টেশন ও শেষের স্টেশন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাওবা তাকে ছেড়ে যায় না। যদি সে অন্য কোন ষ্টেশনে যায় তবে এই (তাওবার) ষ্টেশনও তার সাথে সাথে যায়। তাওবা বান্দার শুরু ও শেষ।” আল্লাহ বলেন, “মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”(সুরা আন- নুর, আয়াত ৩১)


🔎এই আয়াতটি একটি মাদানী সুরার অংশ, যা অবতীর্ণ হয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুমিনগণ ঈমান, হিজরত ও সবরের কঠিন পরীক্ষা দেয়ার পর। এত কিছুর পরেও আল্লাহ তাদের সফলতার জন্য তাওবাকে শর্ত বানিয়েছেন।


🔰আন্তরিক তাওবা ও তার পূর্বশর্ত🔰


🔎আল্লাহ বলেন,“মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করো,আন্তরিক তাওবা।”(সুরা আত-তাহরিম,আয়াত ৮)


🔎ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, “এর মানে হলো এমন সৎ ও দৃঢ় তাওবা যা আগের পাপরাশিকে মুছে দেয় এবং তাওবাকারীর মনে এমন অনুভুতির জন্ম দেয় যা ভবিষ্যতে তাকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে।” (তাফসীর ইবনে কাসীর: ৪/৩৯১)


🔴আলেমদের মতে আন্তরিক তাওবা হলো🔴

নিজেকে তাৎক্ষণিকভাবে গুনাহ থেকে বিরত রাখা, ভবিষ্যতে আর গুণাহের পুনরাবৃত্তি না করার অংগীকার করা এবং অতীতে কৃত গুণাহের জন্য আন্তরিক অনুশোচনা করা। আর যদি কারো অধিকার ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে, তবে তার প্রাপ্য (অর্থ, সম্পদ) মিটিয়ে দেয়া।

নিম্নে আন্তরিক তাওবা সম্পর্কে বিখ্যাত কয়েকজন সলফে সলেহীনদের উদ্ধৃতি দেয়া হলো:


🔎আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) বলেন, “আন্তরিক তাওবা হলো গুণাহের দিকে আর না ফেরা, যেমন করে দুধ গাভীর ওলানে আর ফিরে যায় না। ”

সাঈদ ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেন, “তাওবা কবুল হবার শর্ত তিনটি: তাওবা কবুল না হবার আশংকা, কবুল হবার আশা এবং (আল্লাহর) আনুগত্যের আকাঙ্ক্ষা।”


🔎হাসান (রঃ) বলেন, “আন্তরিক তাওবা হলো পাপকে ঘৃণা করতে ভালবাসা এবং যখনই তা মনে পড়ে সাথে সাথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।”


🔎সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন, “আন্তরিক তাওবা হলো এমন যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে সদুপদেশ দেয়।”


🔎কালবী (রঃ) বলেন, “আন্তরিক তাওবা হলো মন থেকে আনুশোচনা করা, জিহ্বার মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া, পাপ ধ্বংস করা এবং আর কখনো নিশ্চিতভাবে গুণাহের দিকে ফিরে না যাওয়া।”


🔎কুরযি (রঃ) বলেন, “তাওবার উপাদান চারটি। জিহ্বার মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া, শরীর থেকে পাপ মুছে ফেলা, পুনরায় গুনাহ না করার সংকল্প করা এবং অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করা।”


🔎ফুজাইল (রঃ) বলেন, “এটি হলো নিজের গুনাহকে এমন ভাবে চোখের সামনে রাখা, যেমন করে কোন ব্যক্তি তাকে সারাদিন দেখতে পায়।” (অর্থাৎ সব সময় নিজের গুণাহের জন্য লজ্জিত থাকা


🔎আন-নববী (রঃ) বলেন, “প্রতিটি পাপ থেকে তাওবা করা ফরজ। যদি এটি মানুষের অধিকার সম্পর্কিত না হয় তবে এর শর্ত তিনটি - পুরোপুরিভাবে গুনাহ পরিত্যাগ করা, আক্ষেপ ও আনুশোচনা বোধ করা এবং পুনরায় গুনাহ না করার সংকল্প করা। এই তিনটির কোন একটি উপাদান না থাকলে তাওবা কবুল হবে না।” (রিয়াদুস সালিহীন: ১৭)


যদি এটি কোন মানুষের অধিকার সম্পর্কিত হয় তবে অতিরিক্ত চতুর্থ আরেকটি শর্ত আছে, অন্য মানুষের প্রাপ্য ফিরিয়ে দেয়া (যদি তা অর্থ সম্পর্কিত হয়) অথবা ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে তার অধিকার ভঙ্গের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করা।


🔎সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা, আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন প্রত্যেকেরই জীবনটাকে ভালভাবে কাজে লাগানো উচিত, শেষ বিচারের দিনকে স্মরণ করা উচিত। “যারা শিক্ষা গ্রহন করতে চায় ও শুকরিয়া আদায় করতে চায়, তাদের জন্য আমি দিন ও রাতকে সৃষ্টি করেছি পরিবর্তনশীলরুপে।” (সুরা আল-ফুরকান, আয়াত ৬২)


🔎হাসান (রঃ) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন, “যে রাতে নিজেকে সংশোধন করতে ব্যর্থ হলো, তার জন্য দিন আসে। আর যে দিনে নিজেকে সংশোধন করতে ব্যর্থ হলো, তার জন্য রাত আসে।” তিনি আরো বলেন, “একেকটি দিন মানুষকে ডাকে এবং বলে, “হে মানুষেরা! আমি একটি নতুন দিন। আজকের দিনে যা করা হবে আমি তার স্বাক্ষী।”


🔎ঈসা (আলাইহিস সালাম) বলেন, “দিন ও রাত হলো সম্পদের গুদাম, সিন্দুক। খেয়াল রেখো তুমি তাতে কি রাখছো। রাত ও দিনকে সঠিকভাবে কাজে লাগাও।”


এই হলো আন্তরিক তাওবা সম্পর্কে আলেমদের বক্তব্য। গভীরভাবে ভাবুন, দেখুন তা কতটা কঠিন। সেটি অর্জন করার চেষ্টা করুন।


🔰তাওবা🔰

নীচে কিছু মানুষের ঘটনা উল্লেখ করা হলো যারা আন্তরিকভাবে তাওবা করেছেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করেছেন:


🔎আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, “তোমাদের পূর্বযুগে একজন মানুষ ছিল যে নিরান্নব্বইটি খুন করলো এবং তাওবা করতে চাইলো। তাই সে ঐ এলাকার সবচেয়ে বড় আলেমের কাছে গেলো। তাকে জিজ্ঞেস করলো তাওবা করার কোন সুযোগ আছে কিনা। সেই আলেম জবাব দিলেন, না নেই। লোকটি তখন সেই আলেমকেও হত্যা করে একশত পূর্ণ করলো। এরপর লোকটি আরেকজন আলেমের কাছে গেলে তিনি তাকে বললেন এই এলাকা ছেড়ে অন্য আরেকটি এলাকায় যেতে যেখানে মানুষ আল্লাহর ইবাদত করছে। সে তখন যাত্রা শুরু করলো। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার আগে মাঝপথে তার মৃত্যু হয়। তখন রহমত আর গজবের ফেরেশতারা তাকে নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। রহমতের ফেরেশতারা বললেন, সে তাওবা করেছে এবং ঐ শহরের দিকে যাত্রা করেছে। গজবের ফেরেশতারা বললেন, সে তার সারা জীবনে কোন ভাল কাজ করেনি। তখন মানুষের চেহারায় একজন ফেরেশতা এলেন এবং তাদের বললেন দুই জায়গার দুরত্ব মাপতে। তারা মাপলেন। দেখা গেলো সে তার বাড়ির চাইতে তার নতুন গন্তব্যের দিকে অধিকতর নিকটবর্তী। তখন রহমতের ফেরশতারা তার রুহ নিয়ে গেলেন।” (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)


একই হাদীসের আরেকটি বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তার গন্তব্যের নিকটবর্তী জমিনকে আদেশ দিলেন কাছে আসার জন্য আর অন্য অংশকে বললেন দূরে সরে যাওয়ার জন্য। এরপর তারা মেপে দেখলেন, সে ছিল তার (নতুন) গন্তব্যের দিকে এক হাত বেশী এগিয়ে। তাকে মাফ করে দেয়া হলো ।


🔎ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এলো। সে ছিল ব্যভিচারের কারণে গর্ভবতী। সে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি এমন একটি পাপ করেছি যার জন্য আমার উপর ইসলামী শরিয়তের হদ্ (শাস্তি) প্রযোজ্য। সুতরাং আপনি আমাকে শাস্তি দিন।” 

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার অভিভাবককে বললেন তার যত্ন নিতে এবং বাচ্চা প্রসব করার পর তাকে নিয়ে আসতে। তার অভিভাবক তাই করলেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই মহিলার কাপড় শক্ত করে বাঁধলেন এবং তার উপর হদ্ কায়েম করলেন। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই মহিলার জানাজা পড়লেন।


🔎হজরত ওমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি একজন ব্যভিচারী মহিলার জানাজা পড়ছেন?”


🔎রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তার তাওবা এত খাঁটি ছিল যে তা যদি মদিনার সত্তুরজন মানুষের মাঝে ভাগ করে দেয়া হতো, তবুও তা যথেষ্ট হতো। সে নিজেকে আল্লাহর জন্য সপে দিয়েছিল। তুমি কি তার চাইতে উত্তম আর কাউকে পাবে?”


🔎বুরাইদা ইবনে খুসাইব (রঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মাইজ ইবনে মালিক (রাঃ) রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি নিজের উপর যুলুম করেছি। আমি ব্যভিচার করেছি। আমাকে (শাস্তি দিয়ে) পবিত্র করুন।” রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি পর পর তিন দিন এলেন। 

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি গর্ত খুড়ে তাঁকে সেখানে দাঁড়াতে বললেন। তিনি দাঁড়ালে তাঁকে পাথর মেরে হত্যা করা হলো। লোকেরা তাঁর সম্পর্কে দুই ধরণের মতামত দিতে লাগলো। একদলের মতে, তিনি ধ্বংস হয়ে গেছেন আর তার গুনাহ তাঁর ভাল কাজগুলোকে নষ্ট করে দিয়েছে। অন্য দলের মতে তাঁর চাইতে খাঁটি তাওবা আর কারো হতে পারে না।


🔎রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তাঁর তাওবা এতোটাই খাঁটি ছিল যে তা যদি গোটা জাতির মাঝে ভাগ করে দেয়া হত তবুও তা তাদের জন্য যথেষ্ট হতো।”


🔎সুতরাং, হে আল্লাহর বান্দারা! আপনারা দেখতেই পারছেন কিভাবে খাঁটি তাওবা বিশাল পুরষ্কার নিয়ে আসে। তাই সকাল সন্ধ্যা আমাদের আল্লাহর রহমত লাভের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিৎ।


🔎শেষের দুটি ঘটনা সম্পর্কে ইমাম ইবনে রজব (রঃ) বলেন, “একজন তাওবাকারী বান্দাহ বারংবার আত্মগ্লাণিতে ভোগে, কারণ সে নিজের গুণাহের মর্ম বুঝতে পারে। দেখুন এই মানুষগুলো কি রকম অনুশোচনায় ভুগেছিলেন যে নিজেদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে মৃত্যুকে কবুল করে নিয়েছিলেন।”

হ্যাঁ, তাঁরা জানতেন যে, শাস্তি গুনাহকে মুছে দেয়। তাই তারা পরকালের শাস্তির জন্য অপেক্ষা না করে দুনিয়াতেই নিজেদের শুদ্ধ করে নিয়েছিলেন।


🔎ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেন, “যদি তোমরা তাওবাকারী বান্দাহ দেখতে চাইতে তবে দেখতে পেতে আল্লাহর বাণী “তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করো, আন্তরিক তাওবা' শুনে শেষ রাতে তার চোখ আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত। তোমরা আরো দেখতে পেতে তার খাওয়া-দাওয়া খুবই সামান্য, সে শোকে ভারাক্রান্ত। তার শরীর ক্রমাগত রোজা রাখার কারণে দুর্বল, পা দুটি নামাজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত। সে হতো শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে নিঃশেষিত।”


🔰আন্তরিক তাওবার উপকারিতা🔰


আন্তরিকভাবে তাওবা করার অনেক উপকারিতা আছে। সলফে সালেহীনরা সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেন। ইমাম রাগীব ইসফাহানী (রঃ) কিছু প্রয়োজনীয় উপকারিতার কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো:


✳️১। এটি ভুলগুলোকে ঢেকে দেয়। এটি মানুষের অন্তরে শয়তানের প্রবেশপথগুলোকে চিহ্নিত করে। এটি তাওবাকারী বান্দাকে খারাপ আমলের ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক করে।


✳️২। তাওবাকারী বান্দাহ হয় বিব্রত ও ভীত। সে তার প্রভুর দরবারে বিনীত ও নম্র হয়ে ধরনা দেয়।


✳️৩। তাওবাকারী বান্দাহ জীবনের ভাল ও মন্দ দিক সম্পর্কে ধারণা পায়, সে জীবনের মিষ্টি ও তেঁতো দুই স্বাদই পেয়েছে। এভাবে সে অন্য গুনাহগারদের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে থাকে, তাদেরকে ছোট করে দেখে না।

ইমাম ইবনুল কাইয়িমও (রঃ) কিছু উপকারের কথা আলোচনা করেছেন:


✳️১। আল্লাহর চোখে সবচাইতে মহৎ ও প্রিয় ইবাদত হলো তাওবা। তিনি তাদের ভালবাসেন যারা তাওবা করে। কেননা তিনি তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসেন। তিনি তাদের গুণাহের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন যাতে করে তাওবার পর তাদের উপর তাঁর রহমত ও ভালবাসার বৃষ্টি বর্ষণ করতে পারেন।


✳️২। তাওবার এমন মর্যাদা আছে যা আর অন্য কোন ইবাদতের মধ্যে নেই। এ কারণেই বান্দাহ তাওবা করলে আল্লাহ সেই পথিকের চাইতে বেশী খুশী হন যে মরুভুমিতে তার হারানো বাহন খুঁজে পেয়েছে। আল্লাহর এই সন্তুষ্টি তাওবাকারীর অন্তরে গভীর প্রভাব ফেলে। আর তাই তাওবাকারী তার তাওবার মাধ্যমে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।


✳️৩। তাওবা মহান আল্লাহর সামনে বিনয় ও অসহায়ত্বের অনুভুতি নিয়ে আসে যা আর কোন ইবাদাতের মাধ্যমে সহজে পাওয়া যায় না।


✳️৪। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সব চাইতে নিকটবর্তী হন যখন তারা ভগ্ন হৃদয়ে থাকে। তাওবাকারী বান্দাহ অনেক বেশি ইবাদত করে। কেননা বিব্রত বোধ ও শাস্তির ভয়ে তার হৃদয় ভারাক্রান্ত থাকে। মুসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় তাঁকে পাওয়া যাবে। আল্লাহ উত্তর দিয়েছিলেন, সেই সব লোকের মাঝে যাদের অন্তর তাঁর ভয়ে ভারাক্রান্ত। এ কারণেই তিন শ্রেণীর লোকের দোয়া কবুল হয়, কারণ তারা ভগ্ন হৃদয়ের হয়। তারা হলো গুনাহগার, মুসাফির এবং রোজাদার ব্যক্তি।


✳️৫। গুনাহ থেকে তাওবা করা একজন বান্দার জন্য অন্য যে কোন ইবাদতের চাইতে বেশি উপকারি হতে পারে। এ কারণেই সলফে সালেহীনরা বলেছেন, “কখনো কখনো একজন বান্দাহ পাপ করে (এরপর বিনয়ী হয়ে তাওবা করে) এবং জান্নাতে প্রবেশ করে। আবার কখনো কখনো একজন বান্দাহ নেক কাজ করে (এরপর অহংকারী হয়ে যায়) এবং জাহান্নামে প্রবেশ করে।


✳️৬। আল্লাহর বাণী: কিন্তু যারা তাওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎ কর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহকে ভালো আমল দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আল-ফুরকান, আয়াত ৭০)

যারা তাওবা করে, আল্লাহর উপর ঈমান রাখে এবং নেক কাজ করে, তাদের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের।


🔎ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এই আয়াত নাজিল হবার পর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতটা খুশী হয়েছিলেন এতটা খুশি হতে আমি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর কখনো দেখিনি। “তিনি আপনাকে পরিষ্কার বিজয় দান করেছেন” এই আয়াত নাজিল হবার পরেও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন।

আল্লাহ কিভাবে পাপকে ভাল আমলে বদলে দেন এই ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতপার্থক্য আছে।


🔎ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং তাঁর অনুসারীরা বলেন, আল্লাহ মন্দ আমলকে ভাল আমলে রুপান্তর করে দেন। শিরককে ঈমানে, ব্যভিচারকে সৎচরিত্রে, মিথ্যাবাদীতাকে সত্যবাদীতায়, অবিশ্বস্ততাকে বিশ্বস্ততায় পরিবর্তন করে দেন।


🔎সাইদ ইবনে মুসাইয়্যিব (রঃ) বলেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাওবাকারীর খারাপ কাজকে ভাল কাজে বদলে দিবেন। তাওবা নিজেই একটি নেক কাজ। তাই গুনাহগার তার পাপকে ভাল কাজে রুপান্তর করে।


🔎শেখ শাখমী রুস্তাকি (রঃ) বলেন, তাওবা হলো প্রত্যেক গুনাহ থেকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। আল্লাহ বলেন “তিনি পাপ ক্ষমাকারী ও তাওবা কবুলকারী।” (সুরা আল-মুমিন, আয়াত ৩)


🔎আল্লাহ বান্দার দিকে তাঁর বিশাল রহমত নিয়ে এগিয়ে আসেন, “আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সুরা আল-হিজর, আয়াত ৪৯)


তাওবা নেক আমল বাড়ায়। আর (তাওবাবিহীন) পাপ ইবাদত থেকে দূরে ঠেলে দেয়। বলা হয়ে থাকে, ক্রমাগত পাপ মানুষের অন্তরকে শক্ত ও কলুষিত করে দেয়। এমন কি, এটি মানুষকে কুফরী (আল্লাহকে অস্বীকার) করার দিকে (নাউযুবিল্লাহ) কিংবা অন্য কোন বড় গুণাহের দিকে নিয়ে যায়। নিজের কৃতকর্মের জন্য তীব্র অনুশোচনা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া গুনাহগারের আর কোন অবলম্বন নেই ।


বলা হয়ে থাকে, যদি কোন মানুষ তাহাজ্জুদে (রাতের নামাজে) না দাঁড়াতে পারে তবে বুঝতে হবে পাপ এবং ভুল ত্রুটি তার উপর চেপে বসেছে। সুতরাং তাওবা হলো অন্তর থেকে অনুশোচনা করা, গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা, মনকে আনুগত্যের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং আর কখনো গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করা।


🔴তাওবাকারীর তিনটি জিনিস মনে রাখা উচিত🔴

✳️১। গুনাহের তীব্র অনুশোচনা।

✳️২। গুণাহের কারণে ভয়াবহ আযাব।

✳️৩। এগুলোর বিপরীতে বান্দার অসহায়ত্ব।


যারা রোদের তাপ কিংবা পিপড়ার কামড় সহ্য করতে পারে না, তারা কি করে জাহান্নামের আগুন, লোহার হাতুড়ি দিয়ে ফেরেশতাদের আঘাত, উটের মত বড় সাপের কামড় কিংবা গাধার মত আকারের বিচ্ছুর দংশন সহ্য করবে? আমরা আল্লাহর কাছে তাঁর ক্রোধ ও শাস্তি থেকে ক্ষমা চাই। যারা এই বিষয়গুলো স্মরণে রাখবে তাদের পক্ষেই কেবল আন্তরিক তাওবা করা সম্ভব। আল্লাহ তাঁর অসীম রহমতে তার জন্য তা সহজ করে দিবেন।


🔰তাওবার সময়🔰

🔎আল্লাহ তাওবার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুল বশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তাওবা করে। এরাই হলো সেই সব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, সবজান্তা।” (সুরা আন-নিসা, আয়াত ১৭)


🔎মুজাহিদ (রঃ) বলেন, “জেনে বা না জেনে যে ব্যক্তিই গুনাহ করে, গুনাহ ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সে মুর্খ থাকে।”


🔎ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “তার গুনাহ তার অজ্ঞতার অংশ।”


🔎হাসান বসরী (রঃ) বলেন, .অনতিবিলম্বে তাওবা করে..' মানে হলো মৃত্যুর আগেই।”


🔎ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “এর মানে হলো অসুস্থতার আগে।”


🔎ইবনে রজব (রঃ) বলেন, “অধিকাংশ আলেমদের মতে ‘অনতিবিলম্বে' মানে হলো মৃত্যুর আগে, কেননা মৃত্যু খুব নিকটে এবং দ্রুত হয়ে থাকে। ”

এই আয়াত থেকে এটা পরিষ্কার, আল্লাহ শরীরে প্রাণ থাকা পর্যন্ত তাওবা কবুল করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মৃত্যু শয্যায় উপনীত হবার আগ পর্যন্ত আল্লাহ বান্দার তাওবা কবুল করেন।”


এ কারণেই ইবনে রজব (রঃ) বলেন, “এই আয়াতের নির্দেশনা হলো এই যে অসুস্থ হবার আগেই গুনাহগারের তাওবা করা উচিৎ, যাতে সে আল-কোরআনের নির্দেশিত পথে ভুলগুলোকে নেক আমল দ্বারা শোধরাতে পারে।”


তদুপরি, সুস্থ অবস্থায় তাওবা করা হলো সুস্থ দেহে দান করার ন্যায় (যেখানে অন্তিম মুহুর্তের দাবী বা চাপ প্রয়োগ করা হয় না)। মৃত্যুশয্যায় তাওবা করা হলো মৃত্যুশয্যায় দান করার ন্যায় যখন আর কোন উপায় থাকে না। দুটো অবস্থা (সুস্থাবস্থা ও মৃত্যুকালীন সময়) কখনো এক হতে পারে না।


🔎আলী (রাঃ) বলেন, “বান্দাকে নিঃশ্বাস দেয়া হয়েছে যাতে মালাকুল মাওত (মৃত্যুর ফেরেশতা) চলে আসার আগ পর্যন্ত তাওবা করতে পারে। মালাকুল মাওত চলে এলে আর কোন সময় দেয়া হয় না, তাওবাও কবুল করা হয় না।”


🔎ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, “মালাকুল মাওত চলে আসার আগ পর্যন্ত তাওবা করার সুযোগ থাকে।


🔎হে আল্লাহর বান্দারা, একজন মানুষ দুনিয়ার প্রতি আসক্ত থাকলে সে তার জীবনের অবৈধ আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাস থেকে নিজেকে দূরে রাখে না। আর শয়তান মৃত্যু চলে আসার আগ পর্যন্ত তাকে তাওবা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, গড়িমসি করায়। যখন মৃত্যুযন্ত্রণা এসে পড়ে তখন সে অনুশোচনা করে, নিজের বিলম্বের জন্য আক্ষেপ করে। সে আবার জীবন ফিরে পেতে চায় তাওবা ও নেক আমল করার জন্য। কিন্তু তখন এগুলো কোন কাজে আসে না। আল্লাহ আমাদের এই অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।


🔎“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমুখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না। তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ উত্তম বিষয়ের অনুসরণ করো তোমাদের কাছে আযাব আসার আগেই। যাতে কেউ না বলে, আমি আল্লাহর প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করেছি। আর আমি ছিলাম ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের অন্তর্ভুক্ত। অথবা যাতে না বলে, আল্লাহ যদি আমাকে পথ প্রদর্শন করতেন তবে আমি অবশ্যই পরহেযগারদের একজন হতাম। আযাব প্রত্যক্ষ করার সময় যাতে না বলে, যদি কোনরুপে একবার ফিরে যেতে পারি, তবে আমি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে যাবো।” (সুরা আয-যুমার, আয়াত ৫৪-৫৮)


🔎আল্লাহ আরো বলেন, “যখন তাদের কারো কাছে মৃত্যু আসে তখন সে বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে) প্রেরণ করুন যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনই নয়, এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।” (সুরা আল-মুমিনূন, আয়াত ৯৯-১০০)


🔎“তাদের ও তাদের বাসনার মাঝে অন্তরাল হয়ে আছে।” (সুরা সাবা, আয়াত ৫৪)


🔎ওমর ইবনে আব্দুল আযিয (রঃ) বলেন, “যখন তারা (মৃত্যুর সময়) তাওবা করতে চাইবে তখন (তাওবা ও তাদের মাঝে) একটি পর্দা টানিয়ে দেয়া হবে।”

হাসান (রঃ) বলেন, “হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহকে ভয় করো। দুটি জিনিস যেন একই সময় তোমার কাছে এসে না পড়ে - মৃত্যু যন্ত্রনা এবং জীবন হারানোর বেদনা।”


🔎ইবনে সাম্মাক (রঃ) বলেন, যখন তুমি (দুনিয়ার) ফুর্তি ও ঘোরের মাঝে থাকো তখন মৃত্যু আসার আগে মৃত্যুযন্ত্রনা ও কষ্টকে ভয় করো। কেউ জানেনা তুমি কি দেখবে আর কিসের সম্মুখীন হবে।”


🔎ইয়াহইয়া ইবনে মুয়াজ (রঃ) বলেন, “দুনিয়া হলো শয়তানের মদ। যে ব্যক্তি এতে আসক্ত হয়ে যায়, মৃত্যু এলে সে তার হুশ ফিরে পায় আর অন্যান্য অভাগাদের সাথে আফসোস করতে থাকে।”


🔎ইবনে রজব (রঃ) বলেন, “মৃত ব্যক্তিরা সেই সময়ের কথা ভেবে আক্ষেপ করতে থাকে যে সময়টায় তারা কোন তাওবাও করেনি, নেক আমলও করেনি।”


🔎ওমর ইবনে আব্দুল আযিয (রঃ) বলেন, “সেই ব্যাক্তি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে (তাওবা করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে) আল্লাহর রহমত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এভাবে সে আসমান ও জমীনের সমান প্রশস্ত জান্নাত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলো। সে চিরস্থায়ী নেয়ামতের বিনিময়ে ক্ষণিকের ভোগ-বিলাস, বিপুল পরিমাণ নেয়ামতের বিনিময়ে তুচ্ছ পরিমাণ কিনে নিল।”


🔎ইবনে জাওযী (রঃ) বলেন, “অভিনন্দন তাকে যে তাওবার দ্বারা নিজের গুনাহগুলোকে মুছে ফেললো, আল্লাহর কাছে ফিরে যাবার আগে নিজের ভুলগুলোকে সংশোধন করে নিলো এবং অসম্ভব হয়ে উঠার আগে সম্ভবপর জিনিসের পিছনে ছুটলো।” (তাবসিরাহ: ১/২৬)


🔎তিনি (রঃ) আরো বলেন, “তুমি কি এমন কাউকে দেখেছ যে দুনিয়ার চোরাবালিতে আটকে যায়নি? এমন কাউকে কি দেখেছ যে অসুস্থ হয়নি? এমন জীবন কি দেখেছ মৃত্যু এসে যাকে শেষ করে দেয়নি? এই পৃথিবী ধোঁকা দেয়, ঠেকিয়ে রাখে। এখানে আনন্দ মন্দের দিকে নিয়ে যায়। যে দুনিয়ার মোহে আকৃষ্ট হয়, দুনিয়া তাকে ধ্বংস করে। যারা এর থেকে লাভ পেতে চায়, দুনিয়া তাদের ক্ষতি করে। দুনিয়া প্রত্যাশী যারা উল্লাস করে, এটি একদিন তাদের কাঁদাবে। তারা একদিন (মৃত্যুর আগে) আফসোস করবে তাদের পদস্খলনের জন্য, যে সময় তারা দুনিয়াকে পাওয়ার জন্য কত কষ্ট করেছিল। ভয়, আতংক ও আশংকা তাদের কাবু করে ফেলবে। তারা অন্তত একটি ঘন্টা হলেও বেঁচে থাকতে চাইবে।”


🔎হাসান বসরী (রঃ) বলেন, “হে আদম সন্তানেরা তাওবা করার চাইতে পাপ বর্জন করা অনেক সহজ।”


🔰তাওবা কবুল হওয়া বা না হওয়ার লক্ষণ🔰


প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনেরা, ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) তাওবা কবুল হওয়া বা না হওয়ার অনেকগুলো লক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরুপ:

🔎তাওবা কবুল হওয়ার লক্ষণ🔎

✳️১। বান্দাকে তাওবার পর আগের চাইতে ভাল হতে হবে। এর মানে হলো, তাওবাকারী ব্যক্তির দেখা উচিত তার নেক আমল বেড়েছে কি না এবং বদ আমল বা গুণাহের পরিমান কমেছে কি না।

✳️২। মনে সবসময় আল্লাহর ভয় থাকা উচিৎ। আল্লাহর রাগ সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত হবে না।

✳️৩। তাকে সব সময় ভয় ও অনুশোচনা সহ সতর্ক থাকতে হবে।

✳️৪। তাকে আরো বেশী বিনয়ী হতে হবে। নিজেকে তুচ্ছ ও অধম মনে করে আল্লাহর কাছে বিনীত ভাবে দোয়া করতে হবে, “হে আল্লাহ! আপনার ইজ্জতের নামে নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বলছি, আপনি আমার উপর রহমত করুন। আপনার শক্তিমত্তা ও আমার দুর্বলতা, আপনার বিত্ত আর আমার দারিদ্র্য স্মরন করে আপনার কাছে চাইছি। আপনার সামনে এই অপরাধী মাথা নত করছি। আমি ছাড়াও আপনার আরো অনেক বান্দাহ আছে। কিন্তু আমার রব, আমার প্রভুতো কেবলই আপনি। আপনি ছাড়া আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন আশ্রয়। আমি আপনার কাছে নিঃস্ব ভিক্ষুকের মত হাত পেতেছি। আমি কাকুতি মিনতি করছি যেমন করে একজন দীন-হীন অসহায় মানুষ কাকুতি মিনতি করে। আমি একজন ভয়ার্ত ও দুর্দশাগ্রস্থ বান্দার মত চাইছি। আমি তার মত করে আপনার কাছে কামনা করছি যেভাবে কোন ব্যক্তি নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দেয়, যেমন করে কেউ আপনার জন্য নিজের মান মর্যাদা ত্যাগ করে। আমি আপনার কাছে চাই সেই বান্দার মতো যে কান্নাকাটি করে আপনার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে।

এগুলো হলো তাওবা কবুল হওয়ার লক্ষণ।

🥵তাওবা কবুল না হওয়ার লক্ষণ:🥵

✳️১। তাওবাকারীর সংশোধনে দুর্বলতা। পাপ কাজের আনন্দ তার মনে পড়ে যায় এবং তার মন তাতে ডুবে যায়।

✳️২। তাওবাকারী নিজের তাওবা কবুল হবার বিষয়ে এতোটাই নিশ্চিত হয়ে যায় যে সে মনে করে তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে।

✳️৩। চোখে পানি আসে না, গুণাহের শাস্তির কথা ভুলে যায়, মন শক্ত হয়ে যায়।

✳️৪। তাওবাকারী নিজের নেক আমল বাড়ানোর কোন চেষ্টা করে না।

আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে, আমাদের সবসময় ভুল হয়, আমরা নিয়মিত গুনাহ করি। তাই নিয়মিত তাওবার মাধ্যমে আমাদের এ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখা উচিৎ, যেমন করে নোংরা কোন গর্তে পড়ে গেলে কোন মানুষ সেখান থেকে উঠে নিজেকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যদি তোমরা অপরাধ না করো তবে আল্লাহ সেই সব মানুষদেরকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, যারা পাপ করে এবং আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চায়। তখন আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।”

ইবনে রজব (রঃ) এই হাদীসের ব্যখ্যায় বলেন, “মাঝে মাঝে মানুষকে ভুলিয়ে দেয়ার পিছনে আল্লাহর কিছু কারণ আছে। সেটি হলো, এতে করে তারা নিজেদের তুচ্ছ, ছোট মনে করে এবং অযাচিত গর্ব অহংকার পরিত্যাগ করে। গর্বভরে ইবাদত করার চাইতে এটা আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়।”

হাসান বসরী (রঃ) বলেন, “মাঝে মাঝে বান্দাহ এমন অপরাধ করে যা সে কখনোই ভোলে না। তখন এর গ্লানি থেকে সে অনেক বেশী ভীত থাকে যতক্ষণ না জান্নাতে প্রবেশ করে।”

🌹গুনাহের অন্তর্নিহিত সুফল🌹

ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) গুনাহের অন্তর্নিহিত বেশ কিছু সুফলের কথা উল্লেখ করেছেন। তার লিখিত বই ‘মাদারিজুল সালিকিন’ (১/২৩৫) ও ‘মিফতাহু দারি সাদাহ' (২/১৮৪) থেকে কিছু উদ্ধৃতি নিচে দেয়া হলো:


✳️১। বান্দাহ আল্লাহর অপরিসীম শক্তিমত্তার কথা মনে করবে এটা বোঝার জন্য যে, তার পাপ আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে।


✳️২। বান্দাহ বুঝতে পারবে যে একমাত্র আল্লাহই নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত। আর সে নিতান্তই পরমুখাপেক্ষী ও দুর্বল সৃষ্টি।


✳️৩। বান্দাহ আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে যে তিনি তার দোষ গোপন রেখেছেন, প্রকাশ করেননি। অথচ তিনি সর্বদ্রষ্টা ও অসীম শক্তির অধিকারী। এটা তাঁর মহানুভবতা ও উদারতার প্রমাণ।


✳️৪। বান্দাহ তার তাওবা ও ওযর কবুল করায় আল্লাহর মহত্ব ও অসীম ধৈর্যশীলতা অনুধাবন করতে পারবে। তিনি তাঁর ন্যায়বিচারের আলোকে বান্দাহ ও তার গুণাহের বিচার করতে পারতেন। আর সেটা হত অত্যন্ত মর্মান্তিক।


✳️৫। বান্দাহ তার নেক আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য ও নিরাপত্তা অনুভব করবে। আলেমরা তাওফীকের লাভের (অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাহই কারো নেক নিয়্যতকে নেক আমলে পরিণত করতে পারেন) উপর খুব বেশী জোর দিয়েছেন। এ জন্য বান্দাহ সকল কাজে আল্লাহর উপর নির্ভর করবে, নিজের শক্তি সামর্থ্যের উপর নয়।


✳️৬। বান্দার জানা উচিৎ আল্লাহ তার বিরুদ্ধে তাঁর প্রমাণ সম্পন্ন করেছেন, বান্দাহ বলতেও পারবে না কেন বা কিভাবে তা হয়েছে। সে যা করে থাকে তা আল্লাহর মাধ্যমেই করে থাকে। আল্লাহ তার বেশীরভাগ গুনাহই উল্লেখ না করে মাফ করে দেন।


✳️৭। যখন বান্দাহ এই বিষয়গুলো বুঝতে পারবে, তখন তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সে দ্রুত প্রতিশোধ পরায়ণ হবে না। সে আল্লাহর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যদের ত্রুটিগুলো মাফ করে দেবে ও তাদের প্রতি দয়ালু হবে, যেমন করে আল্লাহ তার এতসব অপরাধ থাকা সত্বেও তার প্রতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল।


✳️৮। যখন বান্দাহ তার নিজের দুর্বলতা ও আল্লাহর মহানুভবতা খেয়াল করবে, তখন তার কাছে আল্লাহর সমস্ত উদারতাই হয়ে উঠবে মহান। শুধুমাত্র এই উপকারিতাই সমস্ত সম্পদের চাইতেও যথেষ্ট হবে।


✳️৯। বান্দাহ অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণের চাইতে নিজের ভুল-ভ্রান্তি, গুনাহ শোধরানো নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকবে।

সুবহানাল্লাহ! এই যদি হয় গুনাহ করার পরে উপকারিতা, তবে নেক আমলের উপকারিতা না জানি কত হবে!


🔰তাওবাকারীদের শ্রেণীবিভাগ🔰


তাওবাকারীদের মুলত দুইটি শ্রেণীবিভাগ আছে। এক পক্ষ হলো যারা আন্তরিকতার সাথে তাওবা করে, অন্য পক্ষ হলো যারা আন্তরিকতা নিয়ে করে না। প্রত্যেকেরই বিবেচনা করা উচিৎ তার অবস্থান কোন শ্রেণীতে।

সংকল্পের উপর ভিত্তি করে ইমাম গাযালী (রঃ) তাওবাকারীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। তার সারসংক্ষেপ নিম্নরুপ:


🔰১ম শ্ৰেণী:♻️

যে ব্যক্তি তার তাওবার উপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৃঢ় থাকে, তার গুণাহের স্খলন ঘটায় না এবং যেসব ক্ষেত্রে কোন মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না এমন সব ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ঐ গুনাহ করার ইচ্ছা পোষণ করে না। এটা হলো ধারাবাহিক ও নিয়মিত তাওবা। যারা এটি করতে পারে তারা সেই সব মানুষের অন্তর্ভুক্ত যারা নেক আমলের পিছনে ছোটে। এই তাওবাকে বলে আন্তরিক ও খাঁটি তাওবা আর তাওবাকারীর হৃদয়কে বলে প্রশান্ত আত্মা।

🔎“হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে ফিরে যাও। অতঃপর আমার নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।” (সুরা আল-ফজর, আয়াত ৩০)


🔰২য় শ্ৰেণী:♻️

এমন তাওবাকারী যে তার তাওবার ক্ষেত্রে আন্তরিক এবং কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে অনিচ্ছা থাকা সত্বেও পরিস্থিতির কারণে গুণাহের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। যখনি সে গুনাহ করে, তখনি নিজের মনকে তিরষ্কার করে, ভুলের জন্য দগ্ধ হয়। এটি হলো তিরষ্কারকারী বা সমালোচক আত্মা, কেননা এটি সব সময় নিজেকে ভুলের জন্য তিরষ্কার করে। এই ধরণের তাওবাকারী আল্লাহর কাছ থেকে খুশির খবর পেয়েছে।

🔎“যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে, ছোট খাট অপরাধ করলেও নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার ক্ষমা সুদুর বিস্তৃত” (সুরা আন-নাজম, আয়াত ৩২)

অধিকাংশ আলেমের মতে সগীরা গুনাহ হলো হারাম জিনিসের দিকে তাকানোর মত।


🔰৩য় শ্ৰেণী:♻️

এমন বান্দাহ যে তাওবা করে এবং তদানুসারে নিয়মিত কাজ করে, তবে মাঝে মাঝে তীব্র আবেগ বা লালসার বশবর্তী হয়ে গুনাহ করে বসে। কিন্তু সে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে আনুগত্য বজায় রাখে এবং মোটের উপর গুনাহ থেকে দূরে থাকে। সে সার্বক্ষণিক তাওবার মাধ্যমে নিজের আত্মার যত্ন নেয়। এই আত্মা তার কাজের জন্য দায়ী এবং এজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

🔎“আশা করা যায় আল্লাহ তাদের উপর ক্ষমাশীল হবেন।”(সুরা আত-তাওবা, আয়াত ১০২)

আশংকা আছে, এই ব্যক্তি হয়তো তাওবা করার আগে মারা যাবে। তাই তার এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিৎ এবং তার তাওবার উপরে অটল থাকা উচিৎ।


🔰৪র্থ শ্ৰেণী:♻️

এমন ব্যক্তি যে একবার তাওবা করে কিন্তু আসক্তির কারণে পুনরায় গুণাহের মাঝে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এরপর তার জন্য অনুশোচনাও বোধ করে না, তাওবাও করে না। এ ব্যক্তি সেই সব লোকের অন্তর্ভুক্ত যারা গুণাহের ভিতরে ডুবে থাকে। তাদের অন্তর নিয়মিত তাদেরকে গুণাহের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এভাবে তাদের মৃত্যু কঠিন কোন পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।

যদি সে তাওহিদের উপর মারা যায়, তবে হয়তো দোযখের আজাব ভোগ করার পর তাকে মুক্তি দেয়া হতে পারে। এমন কি অজানা কোন কারণে তাকে সম্পূর্ণ মাফও করে দেয়া হতে পারে। কিন্তু এমন ক্ষমার উপর আশা করে বসে থাকা মোটেও যৌক্তিক নয়।


কিছু লোক আছে যারা বলে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া অসীম। যদি কেউ এদের বলে, “আল্লাহ যদি এত মহান ও উদার হয়ে থাকেন তবে কেন তোমরা নিজেদের ঘরে বসে থাকো না এবং আল্লাহর জন্য অপেক্ষা করো না যে তিনি তোমাদের ভরন পোষণের ব্যবস্থা করে দিবেন?” তারা তখন মুখ ফিরিয়ে বলে, “ভরন পোষণ শুধু উপার্জনের মাধ্যমেই পাওয়া যায়”। তাদের দাবির প্রতিউত্তরে একই ভাবে এই কথাই বলা উচিত “মুক্তি মিলতে পারে তাকওয়ার মাধ্যমে, কেবল মাত্র আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে থাকার মাধ্যমে নয়।


🔎সুতরাং হে আল্লাহর বান্দারা, ভেবে দেখুন আপনি কোন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, “অতঃপর আমি আমার বান্দাদের মাঝে মনোনীতদেরকে কিতাব দান করেছি। তাদের কেউ নিজেদের প্রতি যুলুমকারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী আবার তাদের কেউ কেউ কল্যাণের পথে অগ্রগামী। এটাই মহান আল্লাহর অনুগ্রহ।” (সুরা আল-ফাতির, আয়াত ৩২)


🔎ইমাম কুরতুবী (রঃ) এই আয়াতের একটি ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেছেন, “যারা ছোট গুনাহ করে তারা যালেম। যারা দুনিয়া ও আখেরাতের প্রাপ্য মিটিয়ে দেয় তারা মধ্যপন্থী। আর যারা ভাল কাজের পিছনে দৌঁড়ায় তারা সব চাইতে এগিয়ে।”

তাই আমাদের দিনে রাতে সর্বাবস্থায় তাওবা করা উচিৎ, যাতে আমরা যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না পড়ি। “যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা করে না তারাই যালেম।” (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১১)


🔎মুজাহিদ (রঃ) বলেন, “যারা সকাল সন্ধ্যা তাওবা করে না তারাই যালেম।”

আমাদের সলফে সালেহীনদের চরিত্র এমন ছিল যে তারা আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার উপর নির্ভর করতেন, যদিও তারা নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করতেন। তারা নিজেদের কাজের উপর নির্ভর করতেন না।


একজন ইবাদতকারী এত বেশী ইবাদত করতেন যে তার বুকের পাঁজর দেখা যেত। একজন তাকে বললো, “আল্লাহর দয়া অসীম।” তিনি উত্তর দিলেন, “ঠিক বলেছেন, যদি তাঁর দয়া অসীম না হতো তবে আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের জন্য ধ্বংস করে দিতেন, গুণাহের কথা তো বাদই দিলাম।”


🔎হুজাইফা ইবনে কাতাদা (রঃ) বলেন, “যদি কেউ আমাকে কসম করে বলে, আল্লাহর শপথ! আপনার আমল তো কিয়ামত দিবসে অবিশ্বাসীদের মতো।” আমি তাকে বলতাম তার শপথ সঠিক, তাকে এর জন্য কাফফারা দিতে হবে না।

সলফে সালেহীনরা তাদের আমল সম্পর্কে কখনই উচ্চাশা পোষণ করতেন না, তারা যতই আল্লাহর ইবাদত করুন না কেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারারাত জেগে নামাজ পড়তেন, অনেক সময় তাঁর পা গুলো ফুলে যেতো। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো আল্লাহ তাঁর পুর্বাপর সব গুনাহ মাফ করে দেয়ার পরও কেন তিনি এইরুপ করেন, তিনি বলতেন, “আমি কি শুকরিয়া আদায়কারী বান্দাহ হবো না?”


🔎আব্দুর রাহমান ইবনে হামরাজ আল হারাজ (রঃ) বলেন, “তোমার নিজের ভেতরের সব খারাপ দিকগুলো খুঁজে দেখ। প্রত্যেককে তার নিজের স্বরুপে পুনরুজ্জিবীত করা হবে। যার ভিতরে সব ধরণের পাপ আছে তাকে সব ধরণের লোকের সাথে রাখা হবে।” তারপর তিনি নিজের সমালোচনা করে বলেন, “একজন ঘোষক আগামী দিন ঘোষনা করবে ‘অমুক অমুক গুনাহগার লোকেরা, দাঁড়াও!' সুতরাং হে আরাজ তুমিও দাঁড়াবে তাদের সাথে। তখন আরেকটি ঘোষনা দেয়া হবে ‘অমুক অমুক গুনাহগার লোকেরা, দাঁড়াও!' সুতরাং আবার হে আরাজ তুমি তাদের সাথে দাঁড়াবে। আমি দেখতে পাচ্ছি এভাবে তুমি সব দলের সাথেই দাঁড়াবে।”


🔰তাওবার কিছু নিয়ম🔰


তাওবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম আছে। আমরা অত্যন্ত প্রাসংগিক কিছু নিয়ম উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ।

ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেন,


✳️১। তাওবা করতে গড়িমসি না করা।✔️

গুনাহ করার সাথে সাথে তাওবা করা ফরজ। যদি কেউ তাওবা করতে দেরি করে তবে সে তার জন্য দায়ী হবে। যদি সে পরে তাওবা করে, তবে তাওবা করতে দেরি করার জন্য আলাদা করে তাওবা করতে হবে।


✳️২। একটি গুনাহ থেকে তাওবা করা, অন্যটি থেকে নয়– এমন যেন না হয়।✔️

একটি গুনাহ থেকে তাওবা সঠিক ও খাঁটি হবে না, যদি দেখা যায় একই রকম আরেকটি গুণাহে সে লিপ্ত। কিন্তু যদি, যে গুনাহ থেকে তাওবা করা হচ্ছে, অন্য গুনাহটি একই রকমের না হয় তাহলে তার তাওবা সঠিক ও খাঁটি বলে ধরা হবে।

উদাহরণস্বরুপ, যদি কেউ মদ থেকে তাওবা না করে সুদ খাওয়া থেকে তাওবা করে, তাহলে তার সুদ সংক্রান্ত তাওবা সঠিক ধরা হবে। কিন্তু কেউ যদি হাশিশ (এক ধরনের মাদক) গ্রহণ থেকে তাওবা করে কিন্তু মদ পান চালিয়ে যায়, তাহলে তার এই তাওবা সঠিক হবে না। যেমন কোন ব্যক্তি এক মহিলার সাথে ব্যভিচার থেকে তাওবা করলো, অন্য মহিলার সাথে ব্যভিচার থেকে করলো না। তাহলে বাস্তবে এটি কোন তাওবাই হলো না।


✳️৩। তাওবাকৃত গুণাহের দিকে ফিরে না যাওয়া।✔️

কেউ কেউ বলেন তাওবা কবুলের পূর্বশর্ত হলো যেই গুনাহ থেকে তাওবা করা হচ্ছে তা আর না করা। কিন্তু বেশীরভাগ আলেমরা বলেন যদি কোন বান্দাহ নিজেকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে, অনুশোচনা করে, সেই গুণাহের পুনরাবৃত্তি না করার সংকল্প করে তাহলে তাওবা বৈধ এবং ইনশাআল্লাহ তা কবুল করা হবে। আবার গুণাহের দিকে ফিরে আসলেও তার আগের তাওবা অবৈধ হবে না, যদিও তাকে পুনরায় তাওবা করতে হবে।

শাইখ রুস্তাকি (রঃ) বলেন,


✳️৪। “আমি তাওবা করিনি কারণ আমি জানতাম আমি আবার গুণাহের দিকে ফিরে যাব” এমন ধারণা হলো শয়তানের প্ররোচণা।✔️

কেউ জানে না তার মৃত্যু কখন হবে। তাওবার আগেও কেউ মারা যেতে পারে। বান্দার কাজ হলো তাওবা করা। আল্লাহ তাঁর অসীম রহমতে তাকে হয়তো গুনাহ ত্যাগ করার দৃঢ়তা দান করবেন। যদি কেউ আবার গুনাহ করেও বসে, তবুও অন্তত সে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং তাওবার মাধ্যমে পূর্বের গুনাহ থেকে নিজের অপবিত্রতা মুছে ফেলেছিল। তাওবাকারী সব সময় কোন না কোন উপকারিতা পায়। যদি আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করেন, তাহলে বোঝা যাবে তিনি তাকে খুবই পছন্দ করেন।


🔎“নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদের খুবই পছন্দ করেন।” (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ২২২)

আমাদের জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত হলো আদি পিতা আদম (আঃ), যিনি জান্নাতে একটিমাত্র ভুল করার পরেও নিয়মিত বেশী বেশী তাওবা করেছেন। আমরা অসংখ্য ভুল ভ্রান্তি করি, গুনাহ করি। আমাদের উচিৎ নিয়মিত তাওবা করে যাওয়া এবং আল্লাহর উপর আস্থা না হারানো।


✳️৫। তাওবার পর করণীয়।✔️

তাওবার পর একজন মানুষের আরো বেশী বিনয়ী ও আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকা উচিত। তার আত্মবিশ্বাসী হওয়া উচিৎ নয়। আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে দিয়েছেন এমন ধারণাও মনে পোষণ করা উচিৎ নয়। এটি আরেক ধরণের অহংকার, যা নিজেই একটি গুনাহ। ইবনে হাওয়ারী (রঃ) বলেন, একজন বান্দাহ কোন গুণাহের জন্য তাওবা এবং সে গুণাহের জন্য এত বেশী অনুশোচনা করে যে, সে তার এই অনুশোচনার ও মর্মপীড়ার ফলে জান্নাতে প্রবেশ করে। তখন শয়তান আফসোস করতে থাকে কেন সে লোকটিকে শুরুতে কুমন্ত্রনা দিয়েছিল।


✳️৬। যখন অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় তখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে জানানোও তাওবার অন্তর্ভুক্ত।✔️

হানাফি, শাফেয়ী ও মালেকি মাযহাবের মতানুসারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতির ব্যাপারে জানানো প্রয়োজন। তাঁরা রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই হাদিসটি উল্লেখ করেন “যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের সম্পদ বা সম্মানের ক্ষতি করে, তার অবশ্যই তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ সেই দিনটি চলে আসার আগে যেদিন বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম হবে নেক আমল ও বদ আমল।”


সাধারণত গুনাহ দুইটি হকের সমষ্টি – একটি হলো আল্লাহর হক, অন্যটি বান্দার হক। আল্লাহর হকের ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে। আর বান্দার হকের ক্ষেত্রে তাওবার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বান্দার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এই জন্য খুনের ক্ষেত্রে তাওবা পূর্ণতা পাবে না যতক্ষণ না নিহত ব্যক্তির উত্তরাধীকারদেরকে ক্ষমা অথবা প্রতিশোধ, এই দুয়ের কোন একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।


🔎ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে জানানো বাধ্যতামুলক নয়। একজন মানুষ এটি ছাড়াও তাওবা করতে পারে। কারণ গুণাহের প্রদর্শনী করে কোন লাভ নেই। এতে কেবল ক্ষতি আর বিশৃঙ্খলাই বাড়বে যা ইসলামে হারাম। তবে যদি কেউ কারো সম্মানহানি করে বা গীবত করে, তাহলে অন্য কোন সময় তার প্রশংসা করতে হবে।”


✳️৭। তাওবাকারী কি তার পূর্বেকার পর্যায়ের ঈমান ফিরে পায়?✔️

কেউ কেউ বলেন, সে গুণাহের আগেকার ঈমানের অবস্থায় ফিরে যায় না। তাকে তার আগের ঈমান ফিরে পেতে হলে তার পরিবেশ তৈরি করতে হয়।


অন্যান্যরা বলেন সে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে, কারণ তাওবার দ্বারা তার গুনাহ এমন ভাবে মাফ হয়ে যায় যেন সে আদৌ কোন গুনাহ করেনি।


🔎ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, “বিষয়টি আপেক্ষিক। কেউ হয়তো তার আগের মানে ফিরে যেতে পারে, কেউ হয়তো তার চাইতে উন্নত মানে পৌঁছে যায়।” এর ব্যাখ্যায় একটি গল্প বলা যেতে পারে।


🔎এক মুসাফির শান্তিপূর্ণভাবে এবং সঠিক গতীতে পথ চলছে। সে কিছুক্ষণ দৌড়ায়, কিছুক্ষণ হাঁটে, কিছুক্ষণ পথ চলে আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। পথিমধ্যে সে একটি মরুদ্যান দেখতে পেল যেখানে একজন পথিকের মন মতো পরিষ্কার পানি, পর্যাপ্ত ছায়া ও বিশ্রামের ভাল ব্যবস্থা আছে। তখন সেই পথিক গিয়ে উঠলো সেখানে। হটাৎ একদল ডাকাত এসে তাকে আক্রমণ করে বন্দি করলো। সে তার জীবনহানির আশংকা করতে লাগলো এবং আফসোস করতে লাগলো ঠিকমত গন্তব্যে পৌঁছতে না পারায়। এরপর যখন সে ঘুমিয়ে ছিল তখন তার বাবা তাকে উদ্ধার করলেন এবং বললেন, তোমার সফর চালিয়ে যাও। এইসব শত্রুদের থেকে সাবধান থাকো। এরা তোমাকে হামলা করার জন্য ওত পেতে আছে। যদি তুমি সাবধান থাকো, তবে তুমি তাদের শিকার হবে না। আর যদি অসাবধান হও, তবে তুমি এর ফল ভোগ করবে।


যদি সে মুসাফির বুদ্ধিমান হয়, তবে সে সতর্কতা অবলম্বন করবে এবং আগের চাইতে আরো ভালভাবে সফর করবে। শেষ পর্যন্ত সে তার গন্তব্যে আগের চাইতে আরো ঝামেলামুক্তভাবে ও দ্রুত পৌঁছাবে। কিন্ত যদি সে সাবধান না হয়, শত্রুদের সাথে তার মোকাবেলার কথা ভুলে যায়, তাহলে পরিণতিতে তার প্রাপ্য ফল ভোগ করবে।


✳️৮। তাওবার প্রকারভেদ।✔️

ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, “তাওবা দুই প্রকার। ফরজ ও মুস্তাহাব। ফরজ তাওবা করা হয় যখন কোন ফরজ ছুটে যায় বা হারাম কাজ করা হয়। আর মুস্তাহাব তাওবা করা হয় যখন কোন মুস্তাহাব আমল ছেড়ে দেয়া হয় বা মাকরুহ কাজ করা হয়। যে যথাযথ ভাবে প্রথম তাওবা করে সে মাঝারি মানের পরহেযগার। আর যে উভয় ধরণের তাওবা করে সে আল্লাহর নিকটবর্তী ও অগ্রগামীদের অন্তর্ভুক্ত। আর যারা কোন ধরণের তাওবাই করে না তারা হলো যালেম।


🔰তাওবার সাহায্যকারী উপাদান🔰


✳️১। বান্দাকে আল্লাহর শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা বুঝতে হবে। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিতে পারেন। এই অনুভূতি বান্দাকে সাথে সাথে তাওবা করতে সাহায্য করবে। এজন্য সলফে সালেহীনদের একজন বলেছিলেন, “কেমন গুনাহ করেছ সেটি না দেখে বরং দেখো কার বিরুদ্ধে তুমি গুনাহ করেছ।” আল্লাহ বলেন,

🔎“তোমাদের কি হলো যে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব আশা করছো না, অথচ তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা নুহ, আয়াত ১৩-১৪)


✳️২। বান্দার উচিৎ মৃত্যু ও মৃত্যুর যন্ত্রণার কথা স্মরণ করা। তার কল্পনা করা উচিৎ কতটা নিসঙ্গ আর একাকী হবে তার কবর ! আল্লাহ বলেন,

🔎“প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণভাবে বদলা প্রাপ্ত হবে।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫)

🔎“কেউ জানেনা আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে। কেউ এটাও জানেনা কোথায় তার মরণ হবে।” (সুরা লোকমান, আয়াত ৩৪)

মুজাহিদ (রঃ) বলেন, “যখন আদম সন্তানকে কবরে রাখা হবে তখন কবর তাকে বলবে, “হে আদম সন্তান, লানত তোমার উপর! কোন জিনিস তোমাকে আমার সম্পর্কে ভুলিয়ে রেখেছিল? তুমি কি জানতে না আমি হলাম পোকা মাকড় ভর্তি, নিসঙ্গ আর অন্ধকার ঘর। আমি তোমার জন্য এসব জিনিসই তৈরি করে রেখেছি। তুমি আমার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছো?” ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, “সকালে তুমি আরেকটি সন্ধ্যা আর সন্ধ্যায় তুমি আরেকটি সকাল পাবে এমন আশা করো না। অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, মৃত্যুর আগে জীবনকে গুরুত্ব দাও।”


✳️৩। বান্দার জেনে রাখা উচিৎ যে পরকালের উদ্দেশ্যে করা কাজের মাধ্যমেই উভয় জগতের সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। এই পৃথিবী অল্প কিছু মুহুর্ত মাত্র, যা নিঃশেষ হয়ে যাবে।


🔎“হে মানুষ, তোমাদের রবের সাথে সাক্ষাতের আগ পর্যন্ত তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কঠিন পরিশ্রম করো।” (সুরা আল-ইনশিকাক, আয়াত ৬)

“তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা হলো পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাযিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে সবুজ শ্যামল ভুমিজ লতাপাতা নির্গত হয়। অতঃপর তা এমন শুষ্ক চুর্ণ বিচূর্ণ হয় যে বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এসব কিছুর উপর শক্তিমান।” (সুরা আল-কাহফ, আয়াত ৪৫)


🔎“হে মানুষ, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য, সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাকে প্রতারণায় না ফেলে। সেই প্রবঞ্চক (শয়তান যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে।” (সুরা আল-ফাতির, আয়াত ৫)


🔎রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আল্লাহর কাছে যদি এই দুনিয়ার মূল্য একটা মাছির পাখার সমানও হতো তবে তিনি কোন কাফেরকে এক ফোঁটা পানিও দিতেন না।” (সুনান তিরমিজি) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, “পরকালের তুলনায় দুনিয়া হলো এক ফোঁটা পানির মত যা সাগরে আঙ্গুল ডুবালে তোমার একটি আঙ্গুলের সাথে উঠে আসে।” (সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম)


🔎ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, “বিচারের দিন এই পৃথিবীকে একজন দাঁতহীন, কুশ্রী, বুড়ো মহিলার চেহারায় উপস্থাপন করা হবে। সে মানুষের সামনে উপস্থিত হলে মানুষ জিজ্ঞেস করবে, কে এই মহিলা? তারা আল্লাহর কাছে এই মহিলার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার প্রার্থনা করবে। তখন তাদের বলা হবে, এই হলো সেই দুনিয়া যার জন্য তোমরা ঝগড়াঝাটি করতে, সম্পর্ক ভেঙে দিতে। এই হলো সেই দুনিয়া যার জন্য তোমরা একে অপরকে হিংসা করতে, ঈর্ষা করতে। একে অপরের সাথে প্রতারণা করতে।


সেই মহিলাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলে সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমার অনুসারীরা কোথায়? কোথায় আমার লোকজন? আল্লাহ তখন তার অনুসারী ও লোকজনকে তার সাথে ছুড়ে ফেলার আদেশ দিবেন।”


✳️৪। বান্দার জেনে রাখা উচিৎ, দুনিয়াতে হয়তো কোন শাস্তি তাড়াতাড়ি দেয়া হতে পারে। তার জীবনের সব কিংবা কোন একটি সমস্যা হলো তার গুণাহের ফল।


🔎“আল্লাহ তাদের প্রতি অবিচার করেননি। বরং তারাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছে।” (সুরা আন-নাহল, আয়াত ৩৩)


🔎ফুজাইল (রঃ) বলেন, “আমি যদি আল্লাহকে অমান্য করি, তার ফলাফল আমার গাধা আর চাকরের উপর পড়তে দেখি (অর্থাৎ তারাও সেদিন আমাকে মান্য করে না)।”


🔎ইবনে সিরীন (রঃ) বলেন, “বিশ বছর আগে আমি একজন মানুষকে ছোট করেছিলাম তাকে ‘হে দরিদ্র লোক' বলে, এজন্য আল্লাহ তারপর থেকে আমার উপর দারিদ্র্য দিয়েছেন।”


🔎ফুজাইল (রঃ) বলেন, “একজন মানুষের জামাতে নামাজ ছুটে যায় অতীতে কোন পাপ করার কারণে।”


🔎কাব উল আহবার (রঃ) বলেন, “দোযখের মানুষেরা চরম আফসোস বোধ থেকে নিজেদের হাত কাঁধ পর্যন্ত খেয়ে ফেলবে, অথচ টেরও পাবে না (আফসোস বোধ এতটাই তীব্র হবে)।”


🔎ইয়াজিদ আর রুকাসি (রঃ) বলেন, “আমি নিজেকে দোযখের আগুনে দেখতে পাই একদিকে আমাকে লোহার হাতুড়ি দিয়ে মারা হচ্ছে অন্যদিকে আমি কাঁটা খাচ্ছি আর পুঁজ পান করছি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, তুমি কি চাও? আমি উত্তর দেই, আমি যদি নেক আমল করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম আর এই শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারতাম। তার পর আমি কল্পনা করি আমি বেহেস্তের বাগানে হেটে বেড়াচ্ছি, সেখানে রেশমী কাপড় পরে কুমারী হুরদের সাথে মিলছি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, তুমি কি চাও? আমি উত্তর দেই, আমি চাই পৃথিবীতে ফিরে যেতে, যাতে আমি আরো অনেক বেশী নেক আমল করতে পারি আর বিনিময়ে এখানে আরো অধিক পরিমানে নেয়ামত পেতে পারি।

এরপর আমি নিজেকে বলি, হায়! তুমি কল্পরাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছো। সুতরাং নিজের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করো।”


🔎হে আল্লাহর বান্দারা, আমরা ঘোরের মধ্যে বাস করছি। আসুন আমরা তাওবা করি, অনুশোচনা করি আর আল্লাহর দিকে ফিরে যাই।


🔰অতীত যুগের কাহিনী🔰


আপনি যদি অপ্রতিরোধ্য গুনাহে মোহগ্রস্ত হয়ে থাকেন তবে এগুলো মনে রাখবেন:


⬇️✳️১ - এক লোক ইব্রাহীম আদামের (রঃ) কাছে গেলেন এবং বললেন, হে আবু ইসহাক, আমি সীমালংঘন করেছি (পাপ করার মাধ্যমে)। আমাকে আপনি এমন একটি উপায় বলে দিন যাতে আমার হৃদয় সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে। ইব্রাহীম বললেন, পাঁচটি অভ্যাস গড়ে তুলবে আর তার উপর অটল থাকবে। তাহলে কোন কিছু আর তোমার ক্ষতি করতে পারবে না আর কোন (অন্যায়) ভোগ-বিলাস তোমাকে ধ্বংস করতে পারবে না:


✳️১। তুমি যদি আল্লাহকে অমান্য করতে চাও তবে তাঁর দেয়া কোন কিছু তুমি খেতে পারবে না। তোমাকে যে হাত খাওয়ায় তাতে তুমি কি করে কামড় বসাবে?


✳️২। তুমি যদি আল্লাহকে অমান্যই করবে তবে তাঁর মালিকানাধীন কোন জায়গায় তুমি থাকতে পারবে না। কেমন করে তুমি তাঁর জিনিস খেয়ে আর তাঁর দয়ায় বেঁচে থেকে তাঁকে অমান্য করার ইচ্ছা পোষণ করতে পারো?


✳️৩। তুমি যদি এমন অকৃতজ্ঞই হও আর তাঁকে অমান্য করতে চাও, তবে এমন কোন জায়গা খুঁজে নাও যেখানে তুমি তা গোপনে করতে পারবে। তোমার গুনাহ করার স্পর্ধা হয় কি করে যখন তিনি তোমার সামনে উপস্থিত?


✳️৪। যখন মালাকুল মাওত চলে আসবেন, তখন তুমি তাঁকে বল তোমার রুহ কবজ করতে কিছুটা দেরি করতে যাতে তুমি আন্তরিক তাওবা করে কিছু নেক আমল করে নিতে পারো। ফেরেশতা তোমার আবেদন শুনবেন না। বরং তখনই তোমার রুহকে নিয়ে যাবেন। তাহলে কি করে তুমি পালিয়ে যাওয়ার আশা করছো?


✳️৫। যখন জাহান্নামের ফেরেশতা তোমাকে দোযখের দিকে নিয়ে যেতে আসে, তাঁকে অনুসরণ করো না। কিন্তু তুমি তাকে চাইলেও ঠেকাতে পারবে না। তাহলে তুমি কেমন করে নিজেকে বাঁচানোর আশা করতে পারো?

লোকটি বললো, যথেষ্ট হয়েছে ইব্রাহীম। আমি এখনই আন্তরিক ভাবে তাওবা করছি। লোকটি তাই করলো এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইব্রাহীমের (রঃ) সাহচর্যেই ছিল।


⬇️✳️২ - ফুজাইল ইবনে আয়াজ (রঃ) ছিলেন একজন ডাকাত। তিনি গভীরভাবে একজন তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন। একরাতে যখন তিনি সেই তরুণীর ঘরের দেয়াল বেয়ে উঠছিলেন তখন তিনি শুনতে পেলেন, কেউ একজন সুরা আল-হাদীদের এই আয়াত তেলাওয়াত করছেন:

🔎“যারা মুমিন তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার সময় আসেনি?” (সুরা আল-হাদীদ, আয়াত ১৬)


ফুজাইল এই আয়াত দ্বারা এতই প্রভাবিত হলেন যে তিনি তখনই তাওবা করলেন এবং কাছাকাছি এক নির্জন জায়গায় রাত কাটালেন। সেই রাতে তিনি শুনতে পেলেন কিছু মুসাফির চিৎকার করে বলছে, ‘সাবধান! সাবধান! সামনেই ফুজাইল আছে। সে তোমাদের সব কিছু লুট করে নিয়ে যাবে।' ফুজাইল চিৎকার করে বললেন, “ফুজাইল তাওবা করেছে।' তিনি মুসাফিরদের নিরাপদ সফরের নিশ্চয়তা দিলেন। ফুজাইল ইবনে আয়াজ হয়ে গেলেন হেদায়েতের পথ প্রদর্শক। আজও তাঁর বাণী উল্লেখ করা হয়।



⬇️✳️৩ - এক দুঃস্বপ্ন মহান দরবেশ মালিক ইবনে দিনার (রঃ) কে তাওবার দিকে নিয়ে যায়। তাঁকে তাঁর তাওবার পিছনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

আমি ছিলাম পুলিশের লোক এবং মদ্যপায়ী। আমার এক দাসী ছিল যে আমার সাথে খুব ভাল আচরণ করতো। তার গর্ভে আমার এক মেয়ে হয়, যার প্রতি আমার তীব্র অনুরাগ ছিল। যখন সে হাঁটতে শিখলো তখন তার প্রতি আমার ভালবাসা আরো বেড়ে যায়। আমি যখন মদ খেতে যেতাম তখন সে এসে আমার মদের গ্লাস ধরে টান দিত আর সব আমার কাপড়ের উপর গড়িয়ে পড়ত। আমার মেয়ের বয়স যখন দুই বছর, তখন সে মারা যায়। আমি অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়লাম। সেই বছর এক শুক্রবারে ১৫ই শাবান এলো। আমি নামায না পড়েই মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি স্বপ্নে দেখলাম কিয়ামত এসে গেছে, শিংগায় ফু দেয়া হয়েছে, কবরগুলোর পুনরুত্থান ঘটেছে। আরো দেখলাম মানুষদের একত্রিত করা হলো। আমিও ছিলাম তাদের মাঝে। 

আমি আমার পিছনে হিস হিস শব্দ শুনতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটা নীল কালো বিশাল সাপ আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি ভয়ে আতংকে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। আমি তখন একজন বুড়ো মানুষের মুখোমুখি হলাম। তার পরনে ছিল সুন্দর পোষাক, গায়ে সুগন্ধী। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে বললাম। তিনি কেঁদে উঠে বললেন তিনি অনেক দুর্বল আর সাপটি তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি আমাকে বললেন দৌড়াতে। হয়তো সামনে এমন কাউকে পাব যে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। 

আমি দৌড়ে একটা উচু জায়গায় পৌঁছে গেলাম। খেয়াল করে দেখি আমি আগুনের উপত্যকার শীর্ষে বসে আছি। আগুন দেখে এতটা ভয় পেলাম যে আমার মনে হলো আমি আগুনে প্রায় পড়েই যাচ্ছি। তখন আমি একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। কে যেন বলছে, এখান থেকে চলে যাও। তুমি এখানকার নও। আমি সেই চিৎকার শুনে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। আমি আরো দৌড়াতে লাগলাম। সাপটি তখন আমার পায়ের গোড়ালির সাথে ছিল। আমি সেই বুড়োকে আবার দেখতে পেয়ে আমাকে সাহায্য করতে বললাম। তিনি পুনরায় একই জবাব দিলেন। 

এরপর তিনি আমাকে একটি পাহাড় দেখিয়ে দিলেন। বললেন, আমি সেখানে নিজের কিছু সঞ্চয় পেতে পারি যা হয়তো আমাকে সাহায্য করবে। আমি পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এটি বৃত্তাকার এবং রুপার তৈরি। পাহাড়ে ছিল অনেকগুলো ছিদ্র করা জানালা ও ঝুলন্ত পর্দা। প্রতিটি জানালায় ছিল দুইটা সোনার কপাট। প্রতিটা কপাট রেশমী পর্দা দিয়ে সাজানো। আমি দ্রুত সেই পাহাড়ের দিকে দৌড়ে গেলাম। একজন ফেরেশতা বলে উঠলেন, পর্দা উঠাও। কপাট খুলে দেখো। হয়তো এখানে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষটির কোন সঞ্চয় আছে যা তাকে সাহায্য করবে। 

আমি তখন অনেকগুলো ছোট শিশুকে দেখতে পেলাম যাদের চেহারা জানালার ফাক দিয়ে ছোট চাঁদের মত উকি দিচ্ছে। তখন তাদের একজন বলে উঠল, তোমাদের কি হলো? জলদি আসো, তার শত্রু তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে। তারা এগিয়ে এলো এবং তাদের জানালার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে তাকালো। তারা সংখ্যায় শত শত। আমি তখন আমার মৃত মেয়েটির চেহারা দেখতে পেলাম। 

সে যখন আমাকে দেখলো, তখন সে কেঁদে উঠে বললো, খোদার শপথ! উনি আমার বাবা। এরপর সে জানালা দিয়ে এত দ্রুত বেরিয়ে নুরের পুকুরে লাফ দিল, ঠিক যেন ধনুক থেকে বের হওয়া তীর। তারপর সে আমার দিকে তার হাত বাড়ালো। আমি তার হাত আকড়ে ধরে ঝুলে রইলাম। সে তার আরেকটি হাত দিয়ে সাপটিকে তাড়িয়ে দিল।

এরপর সে আমাকে বসালো। আমার কোলের উপর বসে আমার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো, “আব্বা! যারা মুমিন তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার সময় আসেনি?' আমি কাঁদতে শুরু করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কোথা থেকে কোরআন শিখলো। সে বললো এখানকার শিশুরা পৃথিবীতে যা জানতো তার চাইতে বেশী জানে। আমি তখন আমার পিছনে আসা সাপটি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। 

সে জানালো, সেটি হলো আমার খারাপ আমল যা আমাকে দোযখে নিয়ে যেতো। আমি তখন সেই বুড়ো লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আমার মেয়ে বললো, সে হলো আমার ভাল আমল যা এত দুর্বল যে আমাকে সাপটি থেকে রক্ষা করতে পারলো না।

আমি এরপর জানতে চাইলাম, তারা (শিশুরা) পাহাড়ের ভিতরে কি করছে? সে জানাল, এরা সবাই হলো মুসলিমদের মৃত সন্তান। এরা তাদের বাবা মায়ের সাথে দেখা হবার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা কিয়ামতের দিন তাদের বাবা মায়ের জন্য শাফায়াত করবে। মালিক বলেন, আমি আতংকে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমি আমার মদের সব বোতল ভেঙে ফেললাম আর আল্লাহর কাছে তাওবা করলাম। এই হচ্ছে আমার তাওবার কাহিনী।


⬇️✳️৪ -সেই একই ব্যক্তি মালিক ইবনে দিনার (রঃ) একবার বসরার রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখেন এক রাজকীয় সুন্দরী দাসী অনেক চাকর বেষ্টিত হয়ে যাচ্ছিল। মালিক তাকে ডেকে বললেন,

“ও হে দাসী, তোমার মনিব কি তোমাকে বিক্রি করবে?”

“ও হে বৃদ্ধ তুমি কেমন করে এটা বললে?” সে জবাব দিলো। মালিক আবার বললেন, “তোমার মনিব কি তোমাকে বিক্রি করবে?” উত্তর এলো, “যদি তিনি বিক্রি করেন, তবে তোমার মত মানুষেরা কি কিনবে?”

সে বললো, “অবশ্যই! এমন কি তোমার চাইতে ভাল দামে।”

এরপর সে হেসে তার অনুচরদের বললো মালিককে তার কামরায় নিয়ে যেতে। নিজের কক্ষে এসে সে তার প্রভুকে এই ঘটনা বললো। শুনে তিনিও হাসলেন এবং মালিককে দেখতে চাইলেন। মালিককে ভিতরে আনা হলো। তাকে দেখে তিনি প্রভাবিত হলেন।

“তুমি কি চাও” মনিব জিজ্ঞেস করলো।

মালিক বললেন, “তোমার দাসীকে আমার কাছে বিক্রি করো।”

“তোমার কি কেনার মত সামর্থ্য আছে?”

“তার দাম আমার কাছে দুইটা পচে যাওয়া খেজুরের বিচির চাইতে বেশি নয়।” কক্ষের সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।

প্রত্যেকে বিদ্রুপের স্বরে বললো, “কি করে তার দাম এমন হতে পারে?”

মালিক বললেন, “কারণ তার অনেক খুত আছে।”

“আচ্ছা কি তার খুত?”

“সে সুগন্ধি না দিলে তার নিশ্বাস দুর্গন্ধ ছড়ায়। দাঁত না মাজলে তার দাঁত থেকে বাজে গন্ধ আসে। চুল না আঁচড়ালে তার চুল হয়ে পড়ে উকুন ভর্তি আর এলোমেলো। আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে সে হয়ে পড়বে বুড়ো মহিলা। তার হায়েজ হয়, সে প্রস্রাব পায়খানা করে। সম্ভবত সে নিজ স্বার্থের জন্য তোমাদের পছন্দ করে। এমনকি সে হয়তো তোমাদের প্রতি বিশ্বস্তও নয়। যদি তোমরা তার আগে মারা যাও, সে তোমাদের মতই অন্য একজনকে খুঁজে বের করবে।

তোমরা তোমাদের দাসীর জন্য যে দাম চাইছো তার চাইতেও সস্তায় আমি এমন দাসী কিনতে পারি, যে পুরো বিশুদ্ধ কপুরের তৈরি। সে যদি নোনা, বাজে পানিতে তার থুথু ফেলে তবে তা হয়ে যাবে মিষ্টি পানি । সে যদি মৃতদের সাথে কথা বলে, তবে তার মিষ্টি আওয়াজে মৃতরাও সাড়া দিবে। সূর্যের দিকে যদি সে তার হাত বাড়ায়, সূর্য তার উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলবে। যদি সে রাতে আসে, রাত আলোয় ঝলমল করবে। তার পোশাক আর অলংকার নিয়ে যদি সে দিগন্তের মুখোমুখি হত, তবে দিগন্ত তার আলোয় সেজে উঠতো। মেশকাম্বর আর জাফরান দিয়ে তার পরিচর্যা করা হয়। তার বেড়ে ওঠা বাগানে, তাকে খাওয়ানো হয় তাসনিম (স্বর্গের পানি)। সে কখনোই তার মনিবের প্রতি অবাধ্য হয় না। তোমার প্রতি তার ভালবাসা সবসময় অটুট থাকবে।


এই দুই দাসীর মধ্যে কোনটি বেশী মুল্য পাওয়ার অধিকারী?” মালিক ইতি টানলেন।

“সেটি, যার বর্ণনা তুমি দিলে।” মনিব স্বীকার করলেন।

“তাহলে জেনে রাখ, তাকে পাওয়া সম্ভব, তার কাছে যাওয়াও সম্ভব।”

“তার দাম কত? আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন।”

“খুব সস্তা। রাতের কিছু অংশ ব্যয় করো। আন্তরিকতা নিয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করো। যখন নিজের সামনে খাবার আসে, তখন ক্ষুধার্ত মানুষের কথা ভাবো। অতিরিক্ত ভোজনের আকাঙ্খাকে কোরবানী করো (আর ক্ষুধার্তদের খাওয়াও)। রাস্তা থেকে পাথর আর ময়লা সরিয়ে দেও। বাকি জীবন সামান্য জীবিকার উপর কাটাও। এই বিস্মৃতির পৃথিবীর সব দুশ্চিন্তা দূর করো, যাতে তুমি এই পৃথিবীতে একজন সংযমী মানুষ হিসেবে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারো। আগামীকাল মর্যাদার গন্তব্যে শান্তির সাথে যাও আর বেহেশতে বাস করো চিরকালের জন্য।”


মনিব তখন সেই দাসীর দিকে ফিরে বললেন, “হে দাসী তুমি কি শুনেছ আমাদের বুড়ো মানুষটি কি বলেছেন?”

“হ্যাঁ,” সে জবাব দিল।

“সে কি সত্য বলেছে? নাকি সে নেহায়েত গল্পই বললো শুধু?”

“না, তিনি ঠিক বলেছেন। তিনি দয়ালু আর ভাল পরামর্শ দিয়েছেন।”

মনিব তখন চেঁচিয়ে উঠলো, “তাই যদি হয় তবে তুমি আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত, এই এই সম্পত্তি তোমার। আমার আশেপাশের সব নওকরেরা, তোমরা সবাই মুক্ত। তোমরা এই সব সম্পদ নিয়ে যেতে পার। আমার এই বাড়ি আর সবকিছু আল্লাহর পথে দান করে দিলাম।” তারপর সে একটি পর্দার কাপড় ছিড়ে দামী কাপড় বদলে তাই পরে নিল।


তখন দাসীটি বললো, “হে মনিব আপনি ছাড়া আমার কোন জীবন নেই। সেও তার দামী সাজসজ্জা খুলে তার বদলে খুব সাধারণ কাপড় পরে তার মনিবের সাথে বের হয়ে গেলো। মালিক তাদেরকে বের হতে দেখলেন। তিনি এক পথে গেলেন, তারা অন্য পথে।


⬇️✳️৫ - সুলায়মান ইবনে খালিদ (রঃ) বলেন, এক বুড়ি মহিলার এক পরিচারিকার কথা হিসাম ইবনে আব্দুল মালিকের (দামেস্কের খলিফা/১০৫ হিজরী) কাছে উল্লেখ করা হলো। এই তরুণী তার সৌন্দর্য, উত্তম ব্যবহার, কোরআন তেলাওয়াত ও কাব্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। হিসাম কুফার গভর্নরের কাছে চিঠি লিখে বললেন, যত দামই হোক এই মেয়েটিকে দ্রুত তার মালিকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। সাথে তিনি একজন নওকরও পাঠিয়ে দিলেন। গভর্নর যখন চিঠিটি পেলেন, তিনি বুড়ো মহিলার জন্য লোক পাঠালেন। বুড়ি ঐ তরুণীকে ২০০০ দিরহাম ও এমন একটি খেজুরের বাগানের বিনিময়ে বিক্রি করে দিলেন, যাতে প্রতি বছর পাঁচ শত মিসকাল খেজুর ধরতো। গভর্নর মেয়েটিকে রাজকীয় পোশাক পরিয়ে হিসামের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। হিসাম তাকে নিজের বাসা ও অনেকগুলো চাকর দিলেন। তিনি তাকে অনেক মুল্যবান অলংকার এবং জমকালো পোশাকও উপহার দিলেন।

একদিন হিসাম যখন মেয়েটির সাথে একটা অভিজাত সুগন্ধী আর বালিশ বেষ্টিত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, মেয়েটি তাকে কিছু চমকপ্রদ গল্প বললেন আর কিছু কবিতা রচনা করলেন। হঠাৎ সেখানে সাহায্যের জন্য চিৎকার শোনা গেলো। হিসাম বারান্দা থেকে তাকিয়ে অনেক লোকের একটি শবযাত্রা দেখতে পেলেন। সে শবযাত্রার পিছনে ছিল অনেক বিলাপকারী মহিলা। এক বিলাপরত মহিলা চিৎকার করে বলছিল, হায়! তোমাকে আজ কাঠের খাটিয়াতে করে বহন করা হচ্ছে, তোমাকে মৃতদের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমাকে নিঃসঙ্গ কবরে রেখে আসা হবে। অল্পক্ষণের মধ্যে তোমার বিশ্রামের জায়গায় তুমি হয়ে যাবে আগন্তক। ওহে, যাকে আজ স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। হায় যদি আমি জানতাম, যারা তোমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে কি তুমি বলেছ তোমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে। নাকি তুমি তাদের জিজ্ঞেস করেছ, তোমাকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? নাকি তুমি তাদের বলেছ তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে?


হিসাম কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি তাঁর আনন্দ উপভোগ ত্যাগ করে বলতে লাগলেন, “মৃত্যু আসলেই অনেক শোকের।”

ঘাদিদ (মেয়েটি) বললো, “এই বিলাপকারী আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে।”

হিসাম বললেন, “এটি আসলেই মারাত্মক বিষয়। তিনি তার চাকরকে ডাকলেন। তারপর বারান্দা থেকে নেমে চলে গেলেন। ঘাদিদ তার সোফায় শুয়ে রইলো। সেই রাতে সে স্বপ্ন দেখলো কেউ একজন তার কাছে এসে তাকে বলছে,


“তুমি তোমার সৌন্দর্য আর রুপের মোহে ডুবে আছো। তখন তোমার অবস্থা কি হবে, যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, যখন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে আর তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে?” ঘাদিদ আতঙ্কিত হয়ে জেগে উঠলো। নিজেকে শান্ত করার জন্য কিছু পান করলো। তারপর সে তার এক খাদেমকে ডেকে গোসলের আয়োজন করতে বললো। গোসল শেষে নিজের অলংকার আর পোষাক খুলে উলের তৈরী জালাবিয়া পরে কোমরে ফিতা দিয়ে বেধে নিলো। তারপর একটি কাঠির আগায় তার ব্যাগ বেধে নিয়ে দ্রুত হিসামের ঘরে প্রবেশ করলো। হিসাম তাকে চিনতে পারেনি। “আমি ঘাদীদ, তোমার দাসী”, সে জবাব দিলো। “এক সতর্ককারী এসেছিল আমার কাছে, তার সাবধান বাণী আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি আমাকে ভোগ করেছ। এবার আমাকে এই পৃথিবীর দাসত্ব থেকে মুক্তি দাও।”


হিসাম বললেন, “যারা আনন্দ খুঁজে বেড়ায় তাদের মাঝে আছে অনেক ফারাক। তুমি তোমার আনন্দ খুঁজে পেয়েছ। সুতরাং তুমি আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত। কিন্তু তুমি কোথায় যাওয়ার চিন্তা করছ?”

“আমি আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে চাই।”

“যাও,” হিসাম বললেন, “কেউ তোমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।

সে তখন রাজধানী ত্যাগ করে মক্কায় পৌঁছাল। দিনের বেলায় পাখির মতো সে নীড়ে আশ্রয় নিতো, রোজা রাখতো। রাত এলে কাবার চারদিকে তাওয়াফ করে বলতো, “হে আমার সম্পদ, তুমি আমার জীবিকা। আমার আশা নষ্ট করো না, আমার ইচ্ছাগুলোকে পূর্ণ করো। আমার ফিরে যাওয়াকে সুন্দর করো। আর উদার হয়ে আমাকে পুরষ্কার দান করো।” সে অনেক বিখ্যাত হয়ে গেলো আর এইভাবে ইবাদাত করতে করতে মারা গেলো। আল্লাহ তার উপর রহম করুন।


⬇️✳️৬ - ইব্রাহীম ইবনে আদহামের (রঃ) শিষ্য ইব্রাহীম ইবনে বাসাহার (রঃ) বলেন, তিনি একবার ইবনে আদহামকে জিজ্ঞেস করলেন কিভাবে তিনি আল্লাহর প্রতি ঝুঁকলেন। তিনি বলেন,

আমার বাবা ছিলেন বালখের (মধ্য খুরাসান) রাজা। আমরা শিকার করতে ভালবাসতাম। একদিন আমি আমার কুকুরকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বের হলাম। হঠাৎ করে আমার সামনে একটা শিয়াল বা খরগোশ লাফিয়ে উঠলো। তখন আমি আমার পিছন থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম, “তুমি এর জন্য সৃষ্টি হওনি, আর তোমাকে এর জন্য আদেশও দেয়া হয়নি (আনন্দের জন্য শিকার)”। আমি আমার ডানে বামে তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি শয়তানকে অভিশাপ দিলাম এবং এগিয়ে গেলাম। কিন্তু তখন আমি আমার ঘোড়াকে আবার কাঁপতে দেখলাম এবং একই স্বরে একই কথা আবারো শুনতে পেলাম। আমি চারদিকে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে শয়তানকে অভিশাপ দিয়ে আবারো সামনে আগাতে চাইলাম। কিন্তু আমার ঘোড়া আমাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। 

তখন আমি শুনতে পেলাম নীচ থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকছে আর বলছে, “হে ইব্রাহীম! তোমাকে এই জন্য সৃষ্টি করা হয়নি আর তোমাকে এটা করতে আদেশও দেয়া হয়নি।” সুতরাং আমি থামলাম আর বুঝতে পারলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সতর্ককারী আমাকে আমার ঘোরের জগৎ থেকে জাগাতে এসেছেন।

আমি শপথ নিলাম আজ থেকে আল্লাহর কোন আদেশ অমান্য করবো না। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে গেলাম। আমি আমার বাবার একজন রাখালের কাছে গেলাম আর তার লম্বা শার্ট আর কম্বলের সাথে আমার পোশাক বদল করলাম। আমি এরপর পর্বত আর উপত্যকা পেরিয়ে ইরাকে গিয়ে পৌছলাম। সেখানে আমি কিছুদিন কাজ করলাম, কিন্তু আমি আমার উপার্জনের বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। 

আমি একজন আলেমকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বললেন সিরিয়ায় যেতে। তার কথামত আমি সিরিয়ার একটি শহরে পৌছলাম। শহরটির নাম আল-মানসুরা। কিন্তু এখানেও আমি আমার উপার্জন নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আরেকজন আলেম আমাকে বললেন তারুসে যেতে যেখানে কাজের ও হালাল উপার্জনের সুযোগ আছে। আমি সেখানে গিয়ে সাগরের পারে গিয়ে বসলাম। একজন লোক এসে আমাকে তার বাগানের পাহারাদার হিসেবে কাজ করার জন্য নিয়োগ দিলেন। 

আমি বহু বছর সেখানে একজন গ্রাম্য পাহারাদার হিসেবে রয়ে গেলাম। একদিন এক নওকর তার অনেক বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাগানে এসে আমাকে ডাক দিলো। আমি সেখানে গেলে আমাকে বললো বাগানের সবচেয়ে বড় আর উৎকৃষ্ট ডালিম নিয়ে আসতে। আমি সবচেয়ে বড় ডালিম নিয়ে গেলাম তাদের কাছে। সে একটি কেটে দেখলো এটি খুব টক। সে আমাকে বললো, ‘পাহারাদার! তুমি এতদিন ধরে আমাদের বাগানের ফল খাচ্ছো। অথচ তুমি জানো না কোনটা টক আর কোনটা ভাল?' 

আমি তাকে বললাম, “যেসব ফল আমি পাহার দেই, তার কোনোটিই আমি কখনো খাইনি।' চাকরটি তার বন্ধুদের দিকে ফিরে বললো, ‘তোমরা শুনেছ সে কি বললো। ইব্রাহীম আদহাম তার জায়গায় হলে এমনই বলতেন।’

চাকরটি চলে গেলো এবং মসজিদে গিয়ে আমার কথা আলোচনা করলো। এক ব্যক্তি আমাকে চিনতে পারলো। পরের দিন সেই চাকরটি এক দল লোক নিয়ে সেই বাগানে এলো। আমি গাছ পালার আড়ালে লুকিয়ে গেলাম এবং যত দ্রুত সম্ভব সে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলাম।

এভাবে আমার আল্লাহর পথে যাত্রা শুরু হলো। আর এমনি করে আমি তারুস ত্যাগ করে মরুভুমির দিকে পাড়ি জমিয়েছি।


⬇️✳️৭ - আব্দুল্লাহ ইবনে ফুজাইল (রঃ) বলেন, তাঁর ঘরের জন্য একজন দিনমজুরের প্রয়োজন হলো। তিনি বাজারে গিয়ে একটি কম বয়সী রোগা ছেলেকে দেখতে পেলেন। ছেলেটির পরনে ছিল উলের বেল্ট দিয়ে বাঁধা একটা উলের শার্ট। হাতে একটা ব ঝুড়ি আর দড়ি। আব্দুল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কাজ করবে কি না। ছেলেটি এক দিরহাম ও এক দানিকের বিনিময়ে কাজ করতে রাজি হলো। তবে সে শর্ত দিল, যোহর ও আসরের আজান হলে সে কাজ থামিয়ে দিবে। আব্দুল্লাহ এতে রাজি হলেন। 

তিনি ছেলেটিকে বাসায় এনে কি কাজ করতে হবে তা দেখিয়ে দিলেন। ছেলেটি কোন কথা ছাড়া সুন্দরভাবে কাজ করে গেলো। যোহরের আজান দিলে সে আব্দুল্লাহকে তার শর্তের কথা মনে করিয়ে দিল। আব্দুল্লাহ তাকে যেতে বললেন। ছেলেটি নামাজ পড়ে ফিরে এলো এবং আসর পর্যন্ত কাজ করলো। আবার আসরের সময় সে চলে গেলো। তারপর ফিরে এসে দিন শেষ হবার আগ পর্যন্ত কাজ করলো। আব্দুল্লাহ তার পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিলে সে চলে গেলো।

কিছুদিন পর আবারো আব্দুল্লাহর কিছু কাজ করার দরকার হলো। তার স্ত্রী বললেন আগের ছেলেটিকে নিয়ে আসতে। কারণ সে কাজে কর্মে ভাল ও সৎ ছিল। আব্দুল্লাহ ছেলেটিকে অনেক খুঁজেও পেলেন না। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো, ছেলেটি নিসঙ্গতা প্রিয়। সে শুধুমাত্র শনিবারে কাজ করে।

আব্দুল্লাহ শনিবারের জন্য অপেক্ষা করে ছেলেটিকে পেলেন। ছেলেটি একই শর্তে কাজ করতে রাজি হলো। কাজ শেষে আব্দুল্লাহ তাকে কিছু বাড়তি টাকা দিতে চাইলে সে অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যেতে চাইলো। আব্দুল্লাহ তার পিছে পিছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলেন অন্তত তার পারিশ্রমিকটা নিয়ে যেতে। সে তাই নিয়ে চলে গেলো।

কিছুদিন পর আব্দুল্লাহর ছেলেটিকে আবারো প্রয়োজন হলো। তিনি শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে বাজারে গেলেন। কিন্তু সেখানে তিনি তাকে পেলেন না। একজন তাকে বললো ছেলেটি প্রতিদিন এক দানিক খরচ করতো। কিন্তু বর্তমানে ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

আব্দুল্লাহ ছেলেটির বাসায় গেলেন তাকে দেখতে। সে একজন বুড়ো মহিলার ঘরে থাকতো। তিনি দেখেন, ছেলেটি একটি ইটের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আব্দুল্লাহ তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি কিছু চাও?' ছেলেটি বললো, ‘হ্যা যদি তুমি রাজি থাকো। আব্দুল্লাহ সায় দিলেন।

ছেলেটি বলতে থাকল, ‘যখন আমি মারা যাব, আমার দড়ি বিক্রি করে দিও। আমার শার্ট আর বেল্ট ধুয়ে আমার সাথে কবর দিও। আমার শার্টের পকেটে একটা আংটি পাবে। খলিফা হারুনুর রাশিদ এই শহরে এলে তুমি এমন এক জায়গায় দাঁড়াবে, যাতে তিনি তোমাকে দেখতে পান। তারপর তার কাছে গিয়ে তাকে এই আংটি দেখাবে। কিন্তু এই সব কিছু করবে আমাকে কবর দেয়ার পর।' আব্দুল্লাহ তাতে রাজি হলেন।

ছেলেটি মারা গেলে আব্দুল্লাহ তার কথামত সবই করলেন। খলিফা শহরে এলে আব্দুল্লাহ তাকে দেখতে গেলেন এবং জানালেন তার কাছে কিছু গচ্ছিত জিনিস আছে। তিনি আংটিটা দেখালেন। খলিফা তাকে তার ঘরে আসতে বললেন। আব্দুল্লাহ সেখানে গেলে দরবারের সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলা হলো। এরপর খলিফা জানতে চাইলেন আব্দুল্লাহর পরিচয় কি আর কোথা থেকে তিনি এই আংটি পেলেন। আব্দুল্লাহ উভয় প্রশ্নের জবাব দিলেন। 

খলিফা সেই ছেলেটির লম্বা কাহিনী শুনে এতবেশি কাঁদতে লাগলেন যে তার জন্য আব্দুল্লাহর খারাপ লাগলো। ‘হে আমিরুল মুমিনীন,' আব্দুল্লাহ খলিফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই ছেলেটি আপনার কে হয়?”

‘সে আমার ছেলে।’ খলিফা আক্ষেপ করে বললেন।

‘সে এমন হয়ে গেলো কেন?”

‘আমি খলিফা হবার আগে তার জন্ম হয়। সে খুব ভালভাবে বেড়ে ওঠে। কোরআন, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে সে সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে। যখন আমি খলিফা হই, সে চলে গেলো। আমার পার্থিব কোন ধন সম্পদের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না। সে তার মায়ের খুবই প্রিয় ছিল। আমি তার মাকে এই নীলকান্তমণীর দামী আংটিটি দিলাম তাকে দেয়ার জন্য। সে খুব অনিচ্ছা সহকারে আংটিটি নিয়েছিল। তারপর তার মাও মারা গেলো। আর এতদিন পর তুমি একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে তার খবর পেলাম। তুমি আজ রাতে আমাকে তার কবরের কাছে নিয়ে চলো।’

আব্দুল্লাহ খলিফাকে তার ছেলের কবরের কাছে নিয়ে গেলেন। খলিফা অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলেন। তিনি সেখানে রইলেন ভোর পর্যন্ত। তিনি আব্দুল্লাহকে অনুরোধ করলেন তার সাথে থাকতে যাতে করে আব্দুল্লাহকে নিয়ে রাতে তিনি তার ছেলের কবরের কাছে যেতে পারেন। খলিফা বলার আগ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ জানতেন না ছেলেটি খলিফা হারুনুর রশীদের সন্তান।

“আন্তরিক তাওবা” বইয়ের এখানেই সমাপ্তি। একমাত্র আল্লাহই ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করেন। একমাত্র তাঁর রহমতেই সব ভাল কাজ সম্পন্ন হয়।

#ইসলামিক_একাডেমি_এনপি #ইসলাম_ও_পরিবার #পারিবারিক_মূল্যবোধ #সিলাতুর_রহম #কুরআন_ও_সুন্নাহ #পারিবারিক_শিক্ষা #কুরআনিক_পরিবার #হাদিসের_নির্দেশনা #পারিবারিক_সমস্যার_সমাধান #ইসলামিক_লাইফস্টাইল


Post a Comment

0 Comments